ধারাবাহিক কর্মসূচির প্রথম দিনে রাজধানীতে ব্যাপক শোডাউন করেছে ঢাকা মহানগর বিএনপি। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে এককভাবে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে ফের শক্তি দেখাল দলটি। গতকাল বিকালে উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির পৃথক এ কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী অংশ নেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মহানগরের উদ্যোগে কোনো কর্মসূচিতে এত লোকসমাগম হয়নি বলে পদযাত্রায় অংশ নেওয়া নেতা-কর্মীরা জানান। ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে অধীনস্থ আদালতের এবং সরকারের অবজ্ঞা, গায়েবি মামলায় নির্বিচারে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশি হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের লোড শেডিং, আওয়ামী সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি ঢাকায় গতকাল পৃথকভাবে এই কর্মসূচি পালন করে। সমাবেশ ও পদযাত্রায় ব্যাপক সংখ্যক নেতা-কর্মী, সমর্থকের উপস্থিতি ও লোক সমাগমের কারণে সড়কে মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে রাজধানীর প্রতিটি রাস্তায়। ফলে প্রায় অচল হয়ে পড়ে ঢাকা শহর। এতে মানুষকে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
পদযাত্রা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সংকটের ফয়সালা রাজপথেই হবে। ভোট আর মানচিত্র নিয়ে জনগণ সরকারকে আর ছিনিমিনি খেলতে দেবে না। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তারা বলেন, সজাগ থাকুন। কোনো ষড়যন্ত্র বা ফাঁদে পা দেবেন না। সরকারকে হটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে। দুপুর ১২টা থেকেই মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের পদযাত্রাস্থলে আসতে শুরু করেন। একপর্যায়ে দুই স্থানেই নেতা-কর্মীর ঢল নামে। তারা দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নানা স্লোগান দেন। এ সময় নেতা-কর্মীদের হাতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এদিকে পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সড়কগুলোতে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় কর্মসূচি।
মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে বাসাবো বালুর মাঠে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে বিকাল ৫টায় পদযাত্রা শুরু করা হয়। বিশাল পদযাত্রাটি মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গিয়ে শেষ হয়। আর মহানগর উত্তরের উদ্যোগে বাড্ডার শাহজাদপুর সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে শুরু হয় পদযাত্রা। সেখানে ব্যাপক নেতা-কর্মীর উপস্থিত ছিল। পদযাত্রাটি রামপুরা হয়ে মালিবাগ আবুল হোটেলের মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। মহানগর উত্তর বিএনপির কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা শাহজাদপুর সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে পদযাত্রা-পূর্ব বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান। সমাবেশ শেষে সেখান থেকেই পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে রাজধানীর বাসাবো বালুর মাঠের সামনে পদযাত্রা-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক এবং রফিকুল আলম মজনু সমাবেশ দুটি পরিচালনা করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির পদযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৫১ বছরে দেশে-বিদেশে কূটনীতিকদের প্রটোকল প্রত্যাহারের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সরকার বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো ফায়দা পায়নি। তাই সরকার পাগল হয়ে গেছে। আপনারা সজাগ থাকুন। কোনো ষড়যন্ত্র বা ফাঁদে পা দেবেন না। সরকারকে হটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে ইনশা আল্লাহ। এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন, রাকিবুল ইসলাম বকুল, ডা. রফিকুল ইসলাম, তাবিথ আউয়াল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে পদযাত্রা শুরু করেন নেতা-কর্মীরা। পদযাত্রা উত্তর বাড্ডা শাহজাদপুর সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে থেকে শুরু করে রামপুরা হয়ে মালিবাগ আবুল হোটেল মোড়ে এসে শেষ হয়। ড. মোশাররফ বলেন, বাংলাদেশে এখন উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি। দেশের অর্থ পাচার করে সব শূন্য করে দিয়েছে। দেশের মানুষ আজ দুইবেলা পেট পুরে খেতে পারে না। মধ্যবিত্ত আজ গরিব হয়ে যাচ্ছে। সরকার নিজেদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করেছে।তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে দেশের মানুষ ভোট দিতে যায় না। গত কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামে একটি উপনির্বাচনে শুধু ১৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। এতে বোঝা যায় কেউ এ সরকারের অধীনে ভোট দিতে চায় না। কাজেই শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকতে আমরা আর কোনো ভোট হতে দিব না। জনগণ তা হতে দেবে না। তিনি বলেন, এখন আমাদের সামনে একটাই দফা- এই সরকারকে হটাতে হবে। কোনো স্বৈরাচার এমনি এমনি যায় না। তাকে হটাতে হয়। তাই এ সরকারকে হটাতে গণঅভ্যুত্থানের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য আপনারা প্রস্তুতি নেন।
মহানগর দক্ষিণ বিএনপির পদযাত্রা : রাজধানীর মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বাসাবো এলাকায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির পদযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এখন দেশের মানচিত্র লুটপাটের চেষ্টা হচ্ছে। জীবন থাকতে আমরা তা হতে দেব না। বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে এ দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করব ইনশা আল্লাহ। তিনি বলেন, এ সরকার ব্যাংক লুট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি করে দেশের জনগণকে সম্পদহীন করেছে। অথচ বিএনপির সামনের সারির নেতাদের নামে কম করে ৫০টি করে মামলা দিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, শোনা যাচ্ছে আবার নাকি গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। কয়েক দিন আগেই তো গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল। আসলে এ সরকার পাগল হয়ে গেছে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইদানীং উদ্ভট কথা বলেন। তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানের সময়ে নাকি ভোট চুরি হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, আপনি ভোট ডাকাতি করে অন্যদের চোর বলছেন। তিনি আরও বলেন, বিএনপির ১০ দফা দাবিতে আজকের এই বিপুল জনতার উপস্থিতি প্রমাণ করে সরকারের রাজ সিংহাসন কেঁপে উঠেছে। পরে বাসাবো খেলার মাঠ থেকে মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়। বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল কার্যক্রম শুরু হলেও এর আগে থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হন। এ সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফত আলী সপু, নাসির উদ্দিন অসীম, ডা. রফিকুল ইসলাম, মীর নেওয়াজ আলী, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, মহানগর বিএনপির নবী উল্লাহ নবী, হাবিবুর রশীদ হাবিব, তানভীর আহমেদ রবিন, মোশাররফ হোসেন খোকন, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নুরুল ইসলাম নয়ন, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস এম জিলানী, উলামা দলের শাহ নেছারুল হক, শ্রমিক দলের মোস্তাফিজুল করীম মজুমদার প্রমুখ। ছয় দিনের সিরিজ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন আগামীকাল শুক্রবার মহানগর উত্তরের উদ্যোগে শ্যামলী ক্লাব মাঠে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে ২০ মে মতিঝিলের পীরজঙ্গি মাজারের সামনে সমাবেশ করা হবে। দক্ষিণের উদ্যোগে ২৩ মে ধানমন্ডি থেকে পদযাত্রা। ওইদিন একই সময়ে উত্তরের উদ্যোগে গাবতলী থেকে শ্যামলী পর্যন্ত পদযাত্রা। দক্ষিণের উদ্যোগে ২৬ মে যাত্রাবাড়ীতে জনসমাবেশ এবং উত্তরের উদ্যোগে ২৭ মে উত্তরায় জনসমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।