নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকায় সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে দ্বিতীয়বারের মতো আগুনের ঘটনা ঘটল। রবিবার (২৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফ্যাক্টরির ভিতরে থাকা ছয় তলা বিশিষ্ট ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে। ২১ ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফ্যাক্টরিতে থাকা মালামাল আনতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ১৭৬ জন নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন স্বজনরা। স্বজনরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে নিখোঁজদের নাম-ঠিকানা দিয়েছেন। স্থানীয় সূত্র মতে, আগুন লাগা ৬ তলা ভবনের ভিতরে লুটপাট নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটে। এ সময় এক পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে ভবনে আগুন লেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এর আগে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন গাজীর খাদুন এলাকার টায়ার ফ্যাক্টরি ও কর্ণগোপ এলাকার পাইপ ও ট্যাংক ফ্যাক্টরি আগুনে পুড়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানা রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানায় ভাঙচুর করে। এক পর্যায়ে ওই দুটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে রূপগঞ্জের নবকিশোলয় হাইস্কুলের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামি গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার এবং নারায়ণগঞ্জ আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করার পর আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর রবিবার সন্ধ্যার দিকে কয়েক শ’ লোক রূপসী গাজী টায়ার কারখানায় ঢুকে পড়ে। করা হয় ভাঙচুর। স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাধা উপেক্ষা করে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানোর একপর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ভিতরের ৬তলা ভবনে ঢুকে পড়ে কয়েক শ’ লোক। ওই ভবনে কেমিক্যাল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল। ভবনের ভিতরে লুটপাট নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে হাতাহাতি ও মারপিটের ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে ভবনে আগুন লেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচুতে উঠে যায় আগুনের লেলিহান শিখা। এ সময় ভবনের ভিতর আটকে পড়া অনেকেই ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন। খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
সরেজমিন দেখা যায়, ভবনে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সন্ধানে গাজী টায়ার কারখানায় ভিড় করছেন স্বজনরা। ফায়ার সার্ভিসের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা। বেশিরভাগ নিখোঁজ ব্যক্তির বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, মুড়াপাড়াসহ আশপাশের এলাকার।
বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খাঁন, শাহিনসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছেন। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হননি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে তারা ভবনে আটকা পড়েছে। আমাদের বাঁচান। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি। কোনাপাড়া এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, তার মেয়ের জামাই হযরত আলী গাজী টায়ার কারখানায় মালামাল নিতে আসছে। বাড়ি থেকে বলে আসছে। এখন আর তার খোঁজ পাচ্ছি না। মাসাবো এলাকার আসাদ মিয়া বলেন, তার ছোট ভাই বাবু মিয়া কসাইয়ের কাজ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে গাজীর কারখানা থেকে মাল নিতে যায়। রাত ১০টা পর্যন্ত কথা হইছে এরপর থেকে আর কথা হয়নি। বরপা এলাকার সুরাইয়া বেগম বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার নাতি নিরব ও তার বন্ধু মিল্লাত মিলে টায়ার কারখানায় ঢুকে। পরে যেই ভবনে আগুন লেগেছে ওই ভবনে আটকা পড়ে। এখন আর খোঁজ পাচ্ছি না।
ভয়াবহ এই আগুনে কারখানার আশপাশের মার্কেট, হাটবাজার, শিল্প কলকারখানা এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিএনপি নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষক) রেজাউল করিম বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগুন নেভানোর পর নিখোঁজদের ব্যাপারে বলা যাবে। বেলা পাঁচটা পর্যন্ত স্বজনরা আমাদের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজের তালিকা দিয়েছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে সাংগঠনিকভাবে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজী সাহেব অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুটি রোজগারের জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংস করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কোথায় যাবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কেউ কোনো প্রকার অরাজকতা, লুটপাট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। প্রচলিত আইনে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির এডমিন ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাঙচুর লুটপাট অগ্নিসংযোগে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। সরকারের সহযোগিতা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি পুনরায় চালু করা হবে।