জাতীয় পার্টির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের পাঁচবারের এমপি। আসনটিতে জাতীয় পার্টির শক্তিশালী কোনো অবস্থান না থাকলেও জোটের কারণে আসনটি ছাড় দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। একসময় তাঁর আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো থাকলেও সংসদ নির্বাচন করার মতো সংগতি ছিল না। শুরুতে শুভাকাক্সক্ষী ও আত্মীয়দের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নির্বাচন করেছেন। এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক।
আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে ক্ষমতার সবটুকু স্বাদ নিয়েছেন চুন্নু। করিমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নয়াকান্দি গ্রামের শামীম আহমেদ জানান, ২০০১ সালে চুন্নু যখন নির্বাচন করতে আসেন, তখন কাছে থেকে দেখেছি তাঁর আর্থিক দৈন্যদশা। সে সময় তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের একটি বাড়ি ও দুটি বাস বিক্রি করে নির্বাচন করেছিলেন। ওই নির্বাচনে করিমগঞ্জের একটি ভোট কেন্দ্র দখল করে জোরপূর্বক সিল মারা এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে চুন্নুর সমর্থকরা। পরে ওই কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও হেরে যান চুন্নু। কিন্তু ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত এমপি হয়ে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কানাডায় তাঁর একটি বাড়িও রয়েছে বলে জানান তৃণমূলের এই নেতা। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর ভাগ্য বদলে যায় বলে জানান করিমগঞ্জের একাধিক নেতা। সে সময় গার্মেন্ট সেক্টর থেকেই কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সূত্রটি জানায়। করিমগঞ্জ পৌর বিএনপির সিনিয়র নেতা পাভেল বলেন, চুন্নু প্রথমদিকে শুভাকাক্সক্ষী ও আত্মীয়দের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নির্বাচন করেছেন। এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। কী করে তিনি এত বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, সেটা দুদকের কাছে তদন্তের দাবি জানান এই নেতা।
এমপি থাকাকালে তিনি শুধু উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং কাজ শেষে উদ্বোধন করে গেছেন। মূল কাজটি করতেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) আমিরুল ইসলাম খান বাবলু। মূলত বাবলুই ছিলেন চুন্নুর বিশ্বস্ত ও দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত। দুই উপজেলাতেই বাবলুর দুর্নীতির বিষয়টি এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। বাবলু আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির এমপির এপিএসের দায়িত্ব পালন করেছেন নির্দ্বিধায়। চুন্নুর সময়ে প্রকল্পের কাজের ভাগবাঁটোয়ারা, নিজস্ব ঠিকাদারকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, বিশেষ প্রকল্প বণ্টন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রকল্প, টিআর-কাবিখা, ৪০ দিনের কর্মসৃজনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। স্থানীয়রা জানান, এসবের মাধ্যমে এমপি চুন্নু যেমন লাভবান হয়েছেন, এপিএস বাবলুও হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।
এমপি হওয়ার শুরুটা মোটেই সুখকর ছিল না চুন্নুর। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচনে ভোট ডাকাতির আশ্রয় নেন বলে জানান তখনকার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাড়াইলে ভোট ডাকাতি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন চুন্নুর ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম। এরপর প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি এর স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে চুন্নুর কপালে ভাঁজ পড়ে। এ আসনে তখন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। এ অবস্থায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে মোটা অঙ্কের টাকা ঢেলে কোনো রকমে নির্বাচনি বৈতরণী পার হন বলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ। হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আর এলাকায় আসেননি। এখন তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এলাকাবাসী। গত ২৫ আগস্ট করিমগঞ্জে চুন্নুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করেছেন তারা। মিছিল শেষে জাপা মহাসচিব চুন্নুর কুশপুতুল দাহ করা হয়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম ‘গৃহপালিত’ আখ্যা দিয়ে চুন্নুর দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত এবং তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।