রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংস্কার, জাতীয় নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরে ১০টি রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলোর প্রস্তাবনায় উঠে আসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় অভিযুক্তদের দ্রুত বিচার, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ নানা ইস্যু।
গতকাল রাতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম, উপ-প্রেস সেক্রেটারি অপূর্ব জাহাঙ্গীর ও আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বিকাল তিনটা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বৈঠক শুরু হয়।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সংলাপ’-এ অংশগ্রহণ করে গণফোরাম, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, এনডিএম, লেবার পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (আ-প্র) ও জাতীয় পার্টি (আন্দালিব)।
মাহফুজ আলম জানান, দুর্গাপূজার আগে একবার নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গতকালও বেশকিছু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দলগুলো আওয়ামী লীগের নানা অপরাধ, দুর্নীতি, গণহত্যা নিয়ে কথা বলেছে। বিচার দাবি করেছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় আওয়ামী লীগকে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চেয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্ন ব্যক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। বৈঠকে গণহত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা এসেছে। এ ছাড়া তাদের শরিক যারা গত তিন নির্বাচনে অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের নিষিদ্ধ বা তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ করার উপায় নিয়ে কথা হয়েছে। বিগত তিনটি পার্লামেন্ট কীভাবে অবৈধ ঘোষণা করা যায় এ ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করেছেন, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, গার্মেন্ট পরিস্থিতি সমাধানের পাশাপাশি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের কাজ সমান্তরালে চলবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে শিগগিরই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিধিমালার ভিত্তিতে সার্চ কমিটি ঠিক করবে নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন। পরবর্তীতে ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ অন্যান্য বিষয়গুলো আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, গত তিন নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। ওই তিন নির্বাচনে যারা অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই বাধা সৃষ্টি করবে। অনেক দল ও আওয়ামী লীগের শরিক ওই অবৈধ নির্বাচনে গেছে। জাতীয় পার্টিকে আমরা এখন আলোচনার জন্য ডাকছি না। কারণ তারা ফ্যাসিস্টদের দোসর ছিল।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটার শফিকুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা কীভাবে দেশ থেকে পালিয়ে গেল সেটা তদন্ত হচ্ছে। মূলত ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না। পুলিশও কর্ম বিরতিতে ছিল। একটা প্রশাসনিক গ্যাপ ছিল। আমরা শেখ হাসিনাকে অ্যারেস্টের চেষ্টা করছি।
বৈঠক শেষে গণফোরামের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসিন মন্টু গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বাজারের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছি। নির্বাচনের পর যেই ক্ষমতায় যায়, সেই দানবে পরিণত হয়। আমাদের জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত অবাধ সুষ্ঠু নিবাচনের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছি। সংস্কার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছি।
বৈঠকে ২৩টি প্রস্তাব দিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। বৈঠক শেষে দলটির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য যা প্রয়োজন আমাদের প্রস্তাবে সেগুলো রয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলেছি। বিভিন্ন ধরনের টাকার নোট থেকে শেখ মুজিবের ছবি অপসারণ করার কথা বলেছি। গণআন্দোলনে হতাহতদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে বলেছি। ৯৫ ভাগ সরকারি আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার লোটাবাহিনী এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। তাদেরকে চিহ্নিত করে বরখাস্তের অনুরোধ জানিয়েছি। এ ছাড়া পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা, দুর্নীতিতে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি। তিনি দুর্নীতিতে জড়িত আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিদের জেলের ভিতরে রেখে খাইয়ে মোটাতাজা না করে সেনা ব্যারাকে এনে ফ্লোরে রাখার পরামর্শ দেন।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট ড. ফরিদুজ্জামান ফারহাদ বলেন, আমরা সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী এমপিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা ও সম্পদ জব্দ, পাচারের অর্থ ফেরত ও পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা, নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ তিন মাসেই সংস্কার কার্যক্রম শেষ করা, উপদেষ্টা বাড়ানো, দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধানে বড় পরিবর্তন না আনা, ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গায়েবি মামলা প্রত্যাহারসহ ২৩টি প্রস্তাবনা দিয়েছি।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আমরা দ্রুততম সময়ে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলেছি। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন আয়োজন করা যায় কি না সেই ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, দ্রব্যমূল্যে মানুষের হাঁসফাঁস। বিগত সরকারের চেয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছি। স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে দক্ষ ও স্বাধীন করতে হবে। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি বাতিল চেয়েছি। উপদেষ্টাদের কয়েকজন বাদে সবাই ব্যর্থ। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়েছি।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার একটি মামলায় অভিযুক্ত ৪৫ জনের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এটা প্রকাশ করতে বলেছি। এ ছাড়া পাচার করা টাকা দ্রুত ফেরত আনতে হবে। অন্যথায় এই টাকা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।