কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। একের পর এক মব সৃষ্টির ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। সঙ্গে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি এবং ডাকাতির মতো ঘটনায় রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন মানুষ। খোদ পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দিনে গড়ে ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সাধারণ মানুষকে বারবার আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের আন্তরিকতা নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত সরকারের বিভাগগুলো সমন্বিতভাবে কাজ না করার কারণেই এমনটা ঘটছে। সঙ্গে রয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে দেড় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হয়েছেন গণপিটুনিতে (মব জাস্টিস)। বিশেষ করে গত ৩১ মে মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। রবিবার মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীতে তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পল্লবী ১১ নম্বর সেকশন এলাকায় রিফাত নামের এক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। খিলগাঁওয়ে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে খুন হয়েছেন মো. সাগর আহমেদ (২২) নামে এক যুবক। একই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুজন। রাত ২টার দিকে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মো. রকি (৩১) নামে একজন খুন হন।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির বিষয়টি মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং আয়তনের কারণে সাধারণ মানুষের আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। উত্তরায় সাবেক সিইসির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। তবে পুলিশ তাৎক্ষণিক রেসপন্স না করলে পরিস্থিতি আরও বাজে হতে পারত।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে পুলিশের মনোবল অনেক বেড়েছে। যারা মব সৃষ্টির চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
২৫ মে দিবাগত রাতে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল আহসান সাধন খুন হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পর টানা তিন দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও সাতটি খুনের ঘটনা ঘটে। এর আগে ১৮ মে রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডে এক যুবককে প্রকাশ্যে কোপানোর দুই মিনিট ছয় সেকেন্ডের এক ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পুলিশ সদর দপ্তরের গত পাঁচ মাসের অপরাধসংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় ১ হাজার ৫৮৭টি হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে হত্যা মামলা হয়েছিল ১ হাজার ২৬৫টি। এ হিসেবে গত বছরের চেয়ে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩২২টির বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। শতকরা হিসাবে তা বেড়েছে ২০ ভাগ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দিনে গড়ে ১০ জন খুন হয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে হত্যা মামলা হয় ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি, এপ্রিলে ৩৩৬টি। মে মাসে তা আরও বেড়ে হয় ৩৪১টি। এ হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে দেশে ৩১৭ জনকে হত্যা করা হয়।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে না পারলেও আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখন পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য প্রয়োজন ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের সিরিয়াস মনিটরিং।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে পুলিশে নিয়োগ অনেকটা ডিএনএ টেস্ট করেই হয়েছে। তাদের নিয়েই পথ চলতে হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনকে। তাই প্রয়োজন দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। আবার বর্তমান সরকারের উচিত হবে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন সৃষ্টি করে নজির সৃষ্টি করা। কারণ এই কমিশনের ব্যাপারে অনেকেরই প্রত্যাশা রয়েছে।
গতকাল গাজীপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকে আটককালে ‘মব জাস্টিসের যে ঘটনা ঘটেছে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি, নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করা হবে। ডাকাতদের কোনোভাবেই সক্রিয় হতে দেওয়া যাবে না। সম্প্রতি সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়।
২৫ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডিতে অলংকার নিকেতন জুয়েলার্সে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতিতে ব্যবহার করা হয় র্যাবের পোশাক, পরিচয় দেওয়া হয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১০৩৯টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৪২টি, ফেব্রুয়ারিতে ২২৭টি, মার্চে ২৩১টি ও এপ্রিলে ১৯৫টি ও মে মাসে ১৪৪টি মামলা হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২০৮ করে মামলা হয়েছে। এর আগের বছর এ পাঁচ মাসে ৬৫২টি মামলা হয়। গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১৩০টি মামলা হয়।
একই সময় নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাও ব্যাপকহারে বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এই পাঁচ মাসে মোট ৯ হাজার ১০০টি মামলা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি-এইচআরএসএসের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশে ৬৭ ব্যক্তি হত্যার শিকার হন। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩২৫টি রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন ৪৭ জন। বাকি ২০ জন এপ্রিল ও মে মাসে নিহত হন।
সংগঠনটির সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলে সহিংসতা বেশি ঘটেছে। একই সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলে সহিংসতা বেশি ঘটেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে। ঘটছে অন্য অপরাধমূলক ঘটনাও।