জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার দেয়াল টপকে দক্ষিণ প্লাজায় ঢুকে পড়া ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ সরিয়ে দিয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় সেখানে অবস্থানকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরে যেতে সতর্ক করে। এরপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের গাড়ি লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। কয়েকটি স্থানে আগুন জ্বলতেও দেখা যায়।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে অবস্থান নেন বিক্ষুব্ধ জুলাই যোদ্ধারা। সনদে অবমূল্যায়ন, স্বীকৃতি না দেওয়া এবং আইনি ভিত্তি না থাকার অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে ‘জুলাই যোদ্ধারা’ বাইরে গিয়ে বিক্ষোভ করে এবং কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। ঘটে বিস্ফোরণের ঘটনা।
একপর্যায়ে শতাধিক লোক পুনরায় মঞ্চের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে মঞ্চের সামনে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগই একই রঙের পোশাক ও টুপি পরেছিলেন। এ সময় পুলিশ আবার তাদের সরিয়ে দেয়। বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে খামারবাড়ি মোড়ের দিকে ও আরেকটি দলকে আসাদ গেট প্রান্তের দিকে সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খামারবাড়ি মোড়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় বিক্ষোভকারীরা।
তারা পুলিশের এক সদস্যকে মারধর ও পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করে। পুলিশের ব্যারিকেডের জন্য ব্যবহৃত ‘রোড ব্লকার’গুলো একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। দুই ঘণ্টা ধরে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত হন। সংঘর্ষের সময় তারা মূল মঞ্চের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে এবং কিছু স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাশাপাশি পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প ও তাঁবুতে আগুন দেওয়া হয়। পরে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিক্ষুব্ধ একজন বলছেন, পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিচার্জে তাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। এর আগে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জুলাই যোদ্ধারা সংসদ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছিল।
জানা গেছে, প্রায় ৫ শতাধিক বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার মূল মঞ্চ এবং অতিথিদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে পড়েন। বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, সনদ প্রণয়নে তাদের পরামর্শ নেয়নি সরকার। একই সঙ্গে স্বীকৃতি না দিয়ে করা হয়েছে অবমূল্যায়ন। ঘোষণাপত্রের মতো এখানেও আইনি ভিত্তি না থাকার অভিযোগ তাদের। বেলা ১টার দিকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত হন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজসহ কমিশনের সদস্যরা। হত্যার বিচার, জুলাই যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সম্মান, আর্থিক সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে আশ্বস্ত করেন আলী রীয়াজ। তবে আলী রীয়াজের বক্তব্যেও আশ্বস্ত হতে পারেননি জুলাই যোদ্ধারা। এরপরই তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। বিকাল ৪টায় শুরু হয় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলা করা হয়েছে। পুলিশের পাঁচটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের হামলায় একজন উপকমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ সাতজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেন। তবে সংঘর্ষের সময় কাউকে আটক করা হয়নি।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠক মো. মুনতাসিব ফুয়াদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেও জুলাই যোদ্ধারা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছে, তখন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে এখন আর কিছুই করার নেই। পরে জুলাই যোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ জুলাই সনদে যদি জুলাই যোদ্ধাদের মনঃপুত না হয়, তাহলে এটি বাস্তবায়নের কোনো মানে নেই। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ (গতকাল) এখানে অবস্থান নেওয়ার পর যেটি ঘটেছে সেটি দুঃখজনক। কারণ যাদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত, তাদের মারধর করা হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক।
আন্দোলনকারী শামীম হাসান বলেন, শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াকড়ি অবস্থানে থাকলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করতে পারতাম না। আমাদের ভিতরে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে, পরে পেটানো হলো। আমরা আইন ভাঙার পক্ষে না। তবে যেটি করা হয়েছে, সেটি মেনে নেওয়ার মতো না। জুলাই যোদ্ধা আজমী ফেরদৌস বলেন, সংবিধানে জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি না এলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব। এদিকে, গতকাল সন্ধ্যার পর খামার বাড়ি থেকে শতাধিক জুলাই যোদ্ধা মিছিল নিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেটের দিকে যেতে থাকে। এ সময় অবৈধ জুলাই সনদ মানি না, মানব না; আমার ভাইয়ের গায়ে হামলা কেন, জবাব চাই জবাব চাই; ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছিল জুলাই যোদ্ধারা। পরে তারা সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে এসব স্লোগান দিতে থাকে।
ঢামেকে আহত ৩৬ জুলাই যোদ্ধা : জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের ঘটনায় ৩৬ জন আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- আতিকুল গাজী, সাইফুল ইসলাম, লাইলী আক্তার, কামরুল হাসান, শরিফুল ইসলাম, সিনথিয়া, আশরাফুল, হাবিবউল্লাহ, শফিউল্লাহ, শাকিব, মো. লিটন, তানভীর, দুলাল, কামাল, ওমর ফারুক, নুরুল হুদা, আখের উদ্দিন, মিজান, মোস্তাক বিপ্লব ও আল আমিন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, আহতদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। আহতদের মধ্যে একজন জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে ডান হাত হারানো আতিকুল গাজী বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিবাদে আমরা জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধারা আন্দোলন করে আসছিলাম। সরকার আমাদের দাবিতে সাড়া না দিয়ে আজ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করতে গেলে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদে দাঁড়াই। তখন হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং দোকানপাট সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের পর এ সনদকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনের সড়কে বিক্ষোভ করছেন ‘জুলাইযোদ্ধারা’। এ সময় তারা বলেন, ‘এ সনদ ভারতের প্রেসক্রিপশনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এতে দেশের মানুষের কোনো প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি। তাই এটি বাতিল করতে হবে।
আমরা এটি মানি না।’ এ সময় যোদ্ধাদের ওপর হামলার বিচার দাবি করেন তাঁরা। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শতাধিক জুলাইযোদ্ধা মিছিল নিয়ে সংসদ ভবনের ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাঁদের প্রবেশে বাধা দেয়। পরে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন তাঁরা। এ সময় ‘আমরা জুলাইযোদ্ধা আন্দোলন’-এর সংগঠক ইয়াসিন নূর বলেন, ‘জুলাইয়ে আহতদের মারধর করে স্বাক্ষর করা এ সনদ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। কারণ এর আইনি ভিত্তি দেয়নি সরকার। জুলাইযোদ্ধারা এ সনদ মেনে নেবেন না। কারণ এতে জুলাই আন্দোলনে আহতদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।’