মানসিক রোগীকে ‘পাগল’ বলা অপরাধ। কারণ পাগল শব্দটির সঙ্গে ংঃরমসধ বা নেতিবাচক ধারণা জড়িত। এই নেতিবাচক ধারণার পেছনে মানসিক রোগ ও মানসিক রোগী সম্পর্কে মানুষের কিছু ভ্রান্ত ধারণা দায়ী। মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভিন্ন চোখে দেখার কারণ হলো- ভয়। মানসিক রোগীরা যে কোনো সময় অপরের জন্য হুমকিস্বরূপ। মানসিক রোগীর নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বা অস্বাভাবিক, অনিয়ন্ত্রিত বা প্রচণ্ড উত্তেজিত আচরণ করতে পারে- এমন ভয় সবাই করে থাকে। মানসিক রোগী সম্পর্কে মানুষের এ ভয় সব মানসিক রোগীর প্রতি সতর্ক এবং বিরূপ বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে, আর এটাই হলো- stigma. অনেকের ধারণা মানসিক রোগ মানেই মাথা খারাপ বা পাগল। তাই প্রায়ই শোনা যায়, ‘আমি কি পাগল?’ মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। শরীরে যেমন ছোট-বড় রোগ হয়, যেমন- কাশি, সর্দি, জ্বর আবার স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা জটিল শারীরিক রোগ যেমন এইডস, ক্যান্সার ইত্যাদি। ঠিক তেমনি মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ হয়ে থাকে। এগুলো কোনোটি ছোট আবার কোনোটি বড় মাত্রার। ছোট মাত্রার রোগের মধ্যে- যেমন মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা (এনজাইটি ডিসঅর্ডার), বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন), ঘুমের সমস্যা, ফোবিয়া (ভয়), আতঙ্কগ্রস্ত, মৃত্যুভয়, অ্যাডজাস্টমেন্ট বা সম্পর্কের সমস্যা, শুচিবায়িতা (ওসিডি), আবেগের সমস্যা (ইমোশনাল ডিসঅর্ডার) ইত্যাদি যা ‘নিউরোসিস’ বলে পরিচিত। এসব রোগী আপনার-আমার মতো আচরণ করে থাকে। আমি বা আপনি এসব রোগে যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারি। তাহলে কি আমি বা আপনি পাগল বা মাথা খারাপ? বাংলাদেশের ২০০৩-২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের উপরে ১৬.১% মানসিক রোগে আক্রান্ত যার মধ্যে নিউরোসিস ৮.৪%, বিষণ্নতা ৪.৬%, মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ২.৯%। পক্ষান্তরে গুরুতর ধরনের মানসিক রোগ যেমন- সিজোফ্রেনিয়া, মেনিয়া, ডিলুউশনাল ডিসঅর্ডার, অর্গানিক সাইকোসিস বা যাদের বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সংযোগ থাকে না তাদের ‘সাইকোসিস’ বলে। উপরোক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, সাইকোসিসে ভুগছে এমন রোগীর সংখ্যা ১.১%। সাইকোসিসে রোগীর চিন্তার জগৎ, অনুভূতি ও আবেগের বড় পরিবর্তন হয়, আচার-আচরণের ও ব্যক্তিত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং এদের রোগ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি থাকে না। সাইকোসিসে আবার সব রোগীই উত্তেজিত নয়। সাইকোসিস রোগীর ১৮.৫%, Witt K, van Dorn R, Fazel S (২০১৩) অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত আক্রমণাত্মক আচরণ করে, যার প্রভাব বাকি সব রোগীর ওপর পড়ে। ২০০৯ সালের বাংলাদেশের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের নিচের শিশু-কিশোরদের ১৮.৪% মানসিক রোগে ভোগে যার মধ্যে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ৩.৮%, মৃগীরোগ ২.০%, এনুরোসিস বা কাপড়ে প্রসাব করা ৩.০%, মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ১.৩%, শুচিবায়িতা ১.৩%, বিষণ্নতা, আচরণের সমস্যা, মাত্রাতিরিক্ত অবাধ্যতা, মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা, মুড ডিসঅর্ডার যথাক্রমে ১.০% করে, সিজোফ্রেনিয়া ০.১%।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, মানসিক রোগের মধ্যে সাইকোসিস রোগীর সংখ্যা নিতান্ত কম এবং তার মধ্যে অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণ রোগীর সংখ্যা আরও কম। মানসিক রোগীকে পাগল বলা অপরাধ, কারণ এর মাধ্যমে আমি বা আপনি মানসিক রোগীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে রোগীকে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে হেয় করছি এবং মানসিক রোগীর সুচিকিৎসা ব্যাহত করছি। মানসিক রোগীদের প্রতি ভয় বা নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করে মানসিক রোগীর সুচিকিৎসা একান্ত দরকার।
তাই এ বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।
লেখক : মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, রেজিস্ট্রার, মানসিক রোগ বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।