ব্রিটেনের সরকার এমন এক সময়ে পার্লামেন্ট স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিল যখন ব্রেক্সিট নিয়ে কঠিন সংকটে আছে দেশটি। এই সিদ্ধান্তকে অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন সিনিয়র বিরোধী এমপিরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন, নতুন আইন প্রণয়ন করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
ধারণা করা হচ্ছে যে, ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত হবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। স্থগিত থাকবে ১৪ই অক্টোবর পর্যন্ত। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার বাকি থাকবে মাত্র ১৭ দিন।
সমালোচকরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্য এবং সীমান্ত ইস্যুতে নতুন কোন চুক্তিতে না গিয়েই ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রক্রিয়াকে যাতে ব্রিটিশ এমপিরা বাধাগ্রস্ত করতে না পারেন তা ঠেকাতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
সরকার সমর্থকরা অবশ্য বলছেন, ব্রিটিশ ঐতিহ্য অনুযায়ী রাণীর ভাষণ অনুষ্ঠানের জন্য হলেও পার্লামেন্টের কার্যক্রম স্থগিত করাটা জরুরী ছিলো।
সরকার কিভাবে পার্লামেন্ট স্থগিত করতে পারে?
ব্রিটিশ রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী, রাণীর ভাষণ অনুষ্ঠানের জন্য পার্লামেন্ট ভেঙ্গে না দিয়ে বরং এর অধিবেশন স্থগিত করার নিয়ম রয়েছে।
এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রোরোগেশন। যার মানে হচ্ছে, সরকার চাইলে পার্লামেন্টের কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে এবং হাউস অব কমন্সের এমপি কিংবা হাউস অব লর্ডসের সদস্যদের কেউই এতে বাধা দিতে পারে না।
ব্রিটিশ ঐতিহ্য অনুযায়ী, রাণীর বক্তব্যে অনুষ্ঠানের আগে পার্লামেন্ট স্থগিত করা হয়। সাধারণত এর মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টারি বর্ষ শুরু হয় এবং ঐদিন ব্রিটিশ রাণী-বর্তমান রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঘোড়ার গাড়িতে করে বাকিংহাম প্যালেস থেকে সংসদে যান।
রাজকীয় মুকুট পড়ে তিনি হাউস অব লর্ডসে প্রবেশ করেন। সেখানে স্বর্ণ-সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি। তলব করেন হাউস অব কমন্সের এমপিদের।
তবে এর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যে সব নতুন আইন পাস করতে চান সে সম্বলিত একটি ভাষণ পড়ে শোনান রানি। এই ভাষণ সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকেই লেখা হয়ে থাকে।
১৬ শতক থেকে এই ঐতিহ্য চলে আসছে। এখন বছরে এক বার করে এটি পালন করা হয়। তবে শুরু থেকেই এটি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই পালিত হচ্ছে। এটি অনুষ্ঠানের লিখিত কোন নিয়ম-কানুন বা দিনক্ষণ ঠিক করা নেই। তবে ২০১৭ সাল থেকে রাণীর ভাষণের এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে।
পার্লামেন্ট স্থগিতের সময় নিয়ে এতো বিতর্ক কেন?
সরকারি এই সিদ্ধান্তের সমালোচকরা বলছেন, ব্রিটিশ এমপিরা যাতে ব্রেক্সিট নিয়ে কিছু বলতে না পারে তা রোধ করতেই এই সময়টাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নিয়েছে সরকার।
বিরোধীদল লেবার পার্টির ছায়া চ্যান্সেলর জন ম্যাকডোনেল বলেন, "ভুল করবেন না, এটি একটি ব্রিটিশ অভ্যুত্থান।"
"ব্রেক্সিট নিয়ে যার যা-ই অভিমত থাকুক না কেন, যখন একজন প্রধানমন্ত্রীকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ এবং মুক্ত পরিচালনা বাধাগ্রস্ত করার অনুমতি দেয়া হয় তখন ধরেই নিতে হবে যে, এনিয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত পথে রয়েছেন আপনি।"
তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন 'নো-ডিল ব্রেক্সিটে'র বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের ভোট দেয়া ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, ৩১ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে ব্রিটেনের। তবে, ইইউ-এর সাথে বাণিজ্য এবং সীমান্ত নিয়ে কোন চুক্তি চূড়ান্ত আগ পর্যন্ত এই তারিখ পেছাতে আগ্রহী অনেক এমপি। তবে পার্লামেন্ট যদি আগামী ৫ সপ্তাহ বন্ধ থাকে তাহলে আর এটি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে যাবে।
হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন বারকোও এই মতের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। তিনি বলছেন, "এই পদক্ষেপ সংবিধানের অবমাননা।"
তিনি বলেন, যেভাবেই এটিকে পরিবেশন করা হোক না কেন, চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে, পার্লামেন্ট স্থগিতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অধিবেশনে ব্রেক্সিট নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করা।
"এই মুহূর্তে জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়গুলোর একটি পার করছে ব্রিটেন। পার্লামেন্টের নিজস্ব মতামত দেয়াটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক?
এই সিদ্ধান্ত কি গণতন্ত্রের প্রতি একটি অপমান কিনা এবং একইসাথে এমপিদের বিতর্ক এবং ব্রেক্সিট নিয়ে একটি সম্ভাব্য ভোটাভুটির পথ বন্ধ করে দেবে? এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, "না। এটা একেবারেই সত্য নয়।"
তিনি বলেন, এর একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো সরকারের নতুন এজেন্ডা তুলে ধরা। আমাদের নতুন আইন প্রয়োজন। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আমরা নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিল উত্থাপন করবো। আর এজন্যই রাণী সংসদে তার ভাষণ দেবেন এবং এটি ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। নতুন কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো আমরা।
তবে প্রধানমন্ত্রীর অনেক সমর্থকও স্বীকার করেছেন যে, সময় নির্ধারণ কিছুটা হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সময়সূচি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
"আমি এটা নিয়ে নিশ্চিন্ত। কারণ আমার মনে হয় বরিস জনসন সেটাই করছেন যেটা ব্রেক্সিট কার্যকর করতে করাটা জরুরী। পুরো দেশ এটাই চায়। এজন্য পুরো দেশ ভোট দিয়েছিলো," বলেন কনজারভেটিভ এমপি পওলিন লাথাম।
বিভক্ত দেশ
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে বৈধ অথবা গণতন্ত্রের পরিপন্থী-ব্রিটিশরা একে যেভাবেই দেখুক না কেন শেষমেশ যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো: ব্রেক্সিট। এই ইস্যুটি ব্রিটেনকে বিভক্ত করেছে। এটি শুধু সামাজিক প্রেক্ষাপটেই বিভক্তি তৈরি করেনি বরং পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর আনুগত্যেও বিভক্তি নিয়ে এসেছে।
যারা ব্রেক্সিট সমর্থন করেন তাদের জন্য, পার্লামেন্ট স্থগিতের এই সিদ্ধান্ত শেষমেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার ছোট মূল্য মাত্র।
অন্যদিকে যারা ব্রেক্সিটের বিপক্ষে তাদের কাছে এই সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করেছে।
অনেক ব্রিটিশ নাগরিক যারা ইইউ ত্যাগ করার পক্ষে, তারা অভিযোগ তুলেছেন যে, ব্রিটিশ জনগণের মতামত উপেক্ষা করে পার্লামেন্টের অনেক এমপি ব্রেক্সিট রুখে দিতে চান।
ব্রিটিশ নাগরিকরা ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পক্ষে ৫২ শতাংশ এবং বিপক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট দেন।
এই বিতর্কের মূলে রয়েছে ব্রিটিশ সংবিধান, অন্য দেশগুলোর মতো এর কোন লিখিত রূপ নেই।
এর পরিবর্তে এটি আবর্তিত হয়েছে বহু বছরের প্রথা, পার্লামেন্টের নিয়ম-রীতি, আদালতের রায় এবং ঐতিহাসিক রীতি-নীতিকে ঘিরে।
রাজনীতিবিদেরা যখন সৎ উদ্দেশ্যে দেশ পরিচালনা করতে চান তখন এটা তেমন কোন অসুবিধা তৈরি করে না। কিন্তু ক্রম বিভক্ত ব্রিটেন যেখানে ইইউ ত্যাগ করা না করা নিয়ে বিতর্ক চরমে, যেখানে দু'পক্ষই জয়ের জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি, সেখানে এই পুরনো নিয়ম-কানুন মুখ থুবড়ে পড়ে।
সিনিয়র লেবার এমপি ডেম মার্গারেট বাকেট এ বিষয়ে কিছুটা বিদ্রুপাত্মকভাবেই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, "পার্লামেন্ট ছাড়া সরকার পরিচালনার ঘটনা আমাদের ইতিহাসে নজির রয়েছে। তবে শেষবার এ ধরণের পরিস্থিতি যখন হয়েছিল, তা শেষ হয়েছিল গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে"।
ব্রিটেন ইইউ ছাড়ুক বা নাই ছাড়ুক, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগামী আরো অনেক বছর তিক্ত এবং বিভক্ত থাকবে।-বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত