ভোরে হিমালয়ের চূড়ায় সূর্যালোক যখন প্রথম স্পর্শ করে, তখন নতুন দিনের সূচনা হয়। কিন্তু এই শান্ত, সৌম্য পরিবেশের নিচে লুকিয়ে আছে গভীর উদ্বেগ। হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু হিমালয় অঞ্চলের নয় ভারতের জলসম্পদ এবং উজানের জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে হিমালয়ের পশুপালকদের জীবন-জীবিকার উপর বর্ধিত ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
হিমালয়ের পশুপালকদের দুর্দশা
বিশ্ব হিমবাহ দিবসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তুষার এবং হিমবাহের পরিবর্তন হিমালয়ের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান এবং শীতকালীন শিবিরে পশুপালকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিমালয়ের চারণভূমি এবং ঋতুভিত্তিক স্থানান্তর এই পশুপালকদের জীবনযাত্রার অংশ। কিন্তু হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে এই ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা এখন হুমকির মুখে। চারণভূমির পরিবর্তন, জলের উৎসের অনিশ্চয়তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি তাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
কারা ঝুঁকিতে আছেন?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমবাহ গলে যাওয়ার হার দ্রুততর হয়েছে। এর ফলে জল সুরক্ষার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। হিমালয়ের পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন নদীগুলির উজান অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় দুইশ কোটি মানুষ পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। এই হিমবাহ-গলিত পানি-পুষ্ট নদীগুলোর পরিবর্তনের ফলে কৃষি, জলবিদ্যুৎ এবং পানীয় জলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়াও, হিমবাহ হ্রদ বিস্ফোরণ বন্যা, তুষারধস এবং আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিও বাড়বে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি কেবল জীবনহানি ঘটাবে না বরং অবকাঠামো, কৃষি জমি এবং বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করবে।
হিমবাহ গলে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা: ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা হিমবাহগুলোকে গত শতাব্দীর গড় হারের চেয়ে দ্রুত গতিতে বরফ হারাতে বাধ্য করছে। সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত সর্বশেষ গবেষণা অনুসারে, যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে ২০৯৯ সালের মধ্যে হিন্দু কুশ হিমালয় তার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত হিমবাহ হারাতে পারে। ইউনিভার্সিটি অফ ইন্সব্রুক অস্ট্রিয়ার ড. লিলিয়ান শুস্টার এই গবেষণার সহ-নেতৃত্ব দিয়েছেন। দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছেন, হিমবাহগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ভালো নির্দেশক কারণ তাদের পশ্চাদপসরণ আমাদের নিজেদের চোখে দেখতে দেয় যে জলবায়ু কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে, যেহেতু তারা দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত হয়, তাই হিমবাহের পরিস্থিতি পাহাড়ে বর্তমানে যা দৃশ্যমান তার চেয়েও বেশি খারাপ। শুস্টার আরও বলেন যে, এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। কারণ এই গবেষণা দেখায় যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতি দশমাংশ কমও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি যত কম হবে, হিমবাহ রক্ষার সম্ভাবনা ততই বেশি হবে।
হ্রদে শেষ হওয়া হিমবাহের দ্রুত গলন: হ্রদে শেষ হওয়া হিমবাহগুলো অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের হিমবাহগুলোর চেয়ে দ্রুত গলছে। এর কারণ হলো হ্রদগুলোর উষ্ণায়ণের প্রভাব। এই হ্রদগুলির সংখ্যা এবং আকার উভয়ই বাড়ছে, যা হিমবাহের সামগ্রিক ভর হ্রাসে অবদান রাখছে। হ্রদের পানি উষ্ণ হওয়ায় হিমবাহের তলদেশে বরফ দ্রুত গলে যায়, যা তাদের অস্থির করে তোলে।
প্রাকৃতিক ধ্বংসাবশেষের প্রভাব: উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক ধ্বংসাবশেষযুক্ত হিমবাহগুলো দ্রুত ভর হারাচ্ছে। মোট হিমবাহের প্রায় ৭.৫% হলেও, তারা মোট আয়তন ক্ষতির প্রায় ৪৬.৫% এর জন্য দায়ী। এই ধ্বংসাবশেষ সূর্যের আলো শোষণ করে এবং হিমবাহের বরফকে আরও দ্রুত গলতে সাহায্য করে।
কার্বনের প্রভাব (ব্ল্যাক কার্বন): হিমবাহের উপর পতিত ব্ল্যাক কার্বন কণাগুলি সূর্যের আলো শোষণ করে, যা হিমবাহ গলনকে ত্বরান্বিত করে। এই ঘটনাটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এটি কেবল হিমবাহকেই নয়, আঞ্চলিক পানিসম্পদ এবং জলবায়ু বিন্যাসকেও প্রভাবিত করে। শিল্প কার্যকলাপ, বনভূমি পোড়ানো এবং ডিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া থেকে এই ব্ল্যাক কার্বন নির্গত হয়।
ভৌগোলিক কারণ: বেশ কয়েকটি ভৌগোলিক কারণও দায়ী। হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল, যার মধ্যে পূর্ব নেপাল এবং ভুটান অন্তর্ভুক্ত, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং আবহাওয়ার পার্থক্যের কারণে দ্রুত হিমবাহ গলনের সম্মুখীন হচ্ছে। এই অঞ্চলগুলিতে উচ্চ বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণ তাপমাত্রা হিমবাহের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
অতীতে কি বলছে?
২০২১ সালে 'সায়েন্টিফিক রিপোর্টস' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা দীর্ঘমেয়াদী পর্বত হিমবাহের ওঠানামা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ জিওগ্রাফির ডেপুটি হেড এবং সংশ্লিষ্ট লেখক ড. জোনাথন ক্যারিক বলেছেন, আমাদের অনুসন্ধানসমূহ স্পষ্টভাবে দেখায় যে হিমালয় হিমবাহ থেকে বরফ বর্তমানে গত শতাব্দীর গড় হারের চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বেশি হারে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতির এই ত্বরণ শুধুমাত্র গত কয়েক দশকে দেখা দিয়েছে এবং এটি মানব-প্ররোচিত জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মিলে যায়। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে হিমবাহ গলনের বর্তমান হার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এবং এটি সরাসরি মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফল।
হিমালয়ের হিমবাহের দ্রুত গলন একটি গুরুতর এবং বহুমুখী সমস্যা যা কোটি কোটি মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে প্রভাবিত করছে। এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য অভিযোজন কৌশল প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল