তাজুল ইসলামের ক্ষমতার দাপটে তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামও অবৈধ দখল উৎসবে মেতে ওঠেন। স্বামীর দানবীয় ক্ষমতার শক্তিতে পিছিয়ে ছিলেন না মন্ত্রিপত্নী ফৌজিয়া ইসলামও। সম্পদ অর্জনে ক্ষমতাধর স্বামীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। তাজুল রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট থেকে যখন অবৈধ কমিশনের হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব কষেন, তখন স্ত্রী ফৌজিয়া খামারের শখ পূরণ করতে মেতে ওঠেন বান্দরবানে পাহাড় অবৈধ দখলের উৎসবে। মন্ত্রীর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক হাত কিনে ১০ হাত দখল করে নেন। অসহায় পাহাড়ি পরিবারের শত শত একর জমি বেহাত হয়ে যায়। এ নিয়ে পাহাড়ি জমির মালিকরা মামলা করলেও কোনো লাভ হয়নি, উল্টো তাঁদেরই এলাকাছাড়া করেন ফৌজিয়া ইসলাম। মন্ত্রী তাজুল ও তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের বিচার দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন বান্দরবানের ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা। মানববন্ধনে বান্দরবানের সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম কর্তৃক অসহায় পরিবারের জায়গা, চলাচলের রাস্তা জোরপূর্বক দখলের প্রতিবাদে এবং দখলীয় জায়গা পুনরুদ্ধার করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সেখানকার ভুক্তভোগীরা। বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে দেরাজ মিয়াপাড়া, ফুইট্টা ঝিরি, টংগঝিরি, পুর্গা খোলা, প্রিয়শরীর শতাধিক পাহাড়ি বাঙালি নারী-পুরুষ এ মানববন্ধন করেন।
মানববন্ধনে তাঁরা বলেন, ‘বহিরাগত সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে তাঁদের স্বজন শাহ আলম মুকুলের মাধ্যমে স্থানীয় সন্ত্রাসী মহাকাত আলী, শাহাব উদ্দিন, বাবুল, বেদু, দেলুয়ার, লিয়াকত, সোহরাব, রায়হান, শাহেব মিয়াসহ কয়েকজনকে দিয়ে আমাদের জায়গায় থাকা ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেন এবং জায়গা থেকে সরে না গেলে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় মামলা দেওয়ার পরও এসব সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না।’ তাঁরা তাজুল ইসলাম, ফৌজিয়া ইসলাম, শাহ আলম মুকুলসহ সব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। তাঁদের দাবি, সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ও শাহ আলম মুকুল লামার সরইয়ের দেরাজ মিয়াপাড়ায় ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে এসব অসহায় পরিবারের ৫০০ একরের বেশি জমি বেদখল করেছেন। তাই অতিসত্বর এসব জায়গা উদ্ধার করে অসহায় পরিবারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তাজুল ইসলামও।
বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের আন্দারীর ফুইট্টার ঝিরি এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালিসহ প্রায় ১০০ পরিবারকে ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ দিয়ে নিজ জমিতে কাজ করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ফুইট্টা ঝিরি এলাকার বাসিন্দারা এ অভিযোগ করেন। অভিযোগে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পাড়াবাসীরা ফুইট্টার ঝিরি এলাকায় নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে হঠাৎ তাজুল ইসলামের ম্যানেজারসহ একদল লোক দা ও লাঠি নিয়ে হামলা চালাতে আসে। তাদের ভয়ে পাড়াবাসীরা নিজেদের জায়গা থেকে পালিয়ে যান। সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম লামার সরইতে নিয়মবহির্ভূতভাবে দলিলে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জোর করে দখলে নিয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকার জমি। জমিগুলোও সরকারিভাবে জব্দ করার দাবি জানান তাঁরা।
দুদকে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা না হলে কেউ জায়গা কিনতে পারেন না। তাহলে মন্ত্রী কীভাবে জায়গা কিনলেন? আমরা বান্দরবানে থেকে লিজ পাই না। বাইরে থেকে এসে মন্ত্রী লিজ নেন কীভাবে? সরকার পতনের পর তাজুল ইসলাম পালিয়ে গেলেও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী স্থানীয়দের ওপর হামলা চালিয়ে জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভুক্তভোগী মতিলাল ত্রিপুরা অভিযোগ করেছেন, ‘আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে জুম চাষের জমিগুলো সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও স্বজন শাহ আলম মুকুল মিলে দখল করেছেন। আমরা আমাদের নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হুমকি দেন। এখন আমরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে আছি।’
উল্লেখ্য, বান্দরবানের লামার সরইতে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামসহ তাঁর স্বজনদের ৫০০ একরের বেশি জমি দখলে রয়েছে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর তাজুল ইসলামের স্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের ৩০৪ দশমিক ৫৯ একর জমি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট ক্রোক, ব্যাংক হিসাব ও শেয়ার ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত এ আদেশ দেন। দুদকের পক্ষে উপপরিচালক আবু মোহাম্মদ আনোয়ারুল মাসুদ জব্দ ও অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন। অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া অস্থাবর সম্পদের তালিকায় রয়েছে ১২টি ব্যাংক হিসাব ও ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। ব্যাংক হিসাবে আছে ১ কোটি ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ১৩৫ টাকা। আর ১৪টি প্রতিষ্ঠানে থাকা শেয়ারের মূল্য ৩ কোটি ১৯ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ টাকা। এসব অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৫ টাকা।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলশানে জমিসহ একটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের হালিশহরে চার তলা পাকা বাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ অংশ। এ ছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলায় ইজারা ও বায়না দলিলমূলে ৫৩ দলিলে প্রায় ৩০৪ দশমিক ৫৯ একর জমি। দুদকের আবেদনে বলা হয়, ফৌজিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ৪ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রাখা এবং তাঁর স্বামী মো. তাজুল ইসলাম কর্তৃক অসদুপায়ে উপার্জিত অর্থ দ্বারা স্ত্রীর নামে বর্ণিত ৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ৪ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহায়তা প্রদান এবং ১১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৩ টাকা জমা ও ১৩ কোটি ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৫ টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বমোট ২৭ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ১৭৮ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরপূর্বক আয়ের উৎস আড়াল করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারাসহ পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় একটি মামলা রুজু করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, মামলা তদন্তকালে তাঁর নামে ব্যাংক হিসাবসমূহে গচ্ছিত অর্থের তথ্য পাওয়া যায়; যা তিনি যে কোনো সময় হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন বলে জানা যায়।
এর আগে ১৩ এপ্রিল সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের (৬৯) নামে থাকা ঢাকা, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের ২৮ দশমিক ৬৩ বিঘা জমি, কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় থাকা দুটি বাণিজ্যিক স্পেস, একটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তাঁর নিজ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৫০টি ব্যাংক হিসাব ও শেয়ারে জমা ২৮ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত।