দেশের ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ তরুণ মনে করেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় আসতে পারে। আর ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ তরুণ মনে করে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারে জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনারে জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
চলতি বছরের ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দেশের আট বিভাগে ২ হাজার তরুণ-তরুণীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশ নেওয়া সবার বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ছিল। জরিপে মোট ১৭টি কেইস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরা হয়।
‘পরিবর্তনের পথে তরুণরা; কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও জুলাই আন্দোলনের পর বদলে যাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা’ শীর্ষক এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের সহযোগী গবেষক শাফা তাসনিম। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন অ্যাকশন এইড, বাংলাদেশের পরিচালক ফারাহ কবির। অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান জাতির জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, আমরা সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি কি না। যদি করতে না পারি তাহলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
অ্যাকশন এইড, বাংলাদেশের পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আমাদের অনেক আশা- আকাঙ্খা ছিল। জুলাই আন্দোলন ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। গত এক বছরে নানান জায়গায় ও নানান ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্য দেখতে পেয়েছি ও পাচ্ছি। অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকের কর্মক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেছে। এটা তো আমরা চাইনি।
কোন দলের পক্ষে কত মত : জরিপে ছেলেদের মধ্যে প্রায় ৪০ দশমিক ০৩ শতাংশ বিএনপিকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। জামায়াতের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন ২২ দশমিক ২১ শতাংশ ও এনসিপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সমর্থন কম হলেও তা ছিল উল্লেখযোগ্য-৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। জামায়াতের প্রতি মেয়েদের সমর্থন ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে এনসিপি ও আওয়ামী লীগে ছেলেদের চেয়েও মেয়েদের সমর্থন ছিল বেশি, যা যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এছাড়া, জরিপে গ্রামীণ তরুণদের মধ্যে বিএনপি পেয়েছে ৩৭ দশমিক ৭২ শতাংশ সমর্থন, জামায়াত ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এনসিপি ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। শহুরে তরুণদের ক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি সমর্থনের হার ৩৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জামায়াত ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং এনসিপির পক্ষে ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন।
রাজনীতিতে আগ্রহ কম, সচেতনতার ঘাটতি বেশি : জরিপের প্রতিবেদনে সানেম জানায়, দেশের ৭৬ শতাংশ তরুণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন না। তাছাড়া দেশের ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ দেশের রাজনীতিতেই অংশগ্রহণ করতে চায় না। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ রাজনীতি করতে খুব আগ্রহী। এছাড়া জুলাই আন্দোলনের পর প্রস্তাবিত সংস্কার সম্পর্কে জানেই না ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ। তাছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির তথ্য পেতে তরুণদের ৮৭ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ৭৮ শতাংশ তরুণ জুলাই আন্দোলনের পর পরিবর্তনের জন্য নতুন করে আশাবাদী হয়েছেন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা : প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ তরুণ মনে করেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দেশের জন্য উপকারী নয়। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন ধর্মীয় রাজনীতির কারণে তারা উদ্বিগ্ন। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ স্পষ্ট। ৭৫ শতাংশ মুসলিম এবং ৩২ শতাংশ অমুসলিম তরুণ-তরুণী মনে করেন সংখ্যালঘুরা বর্তমানে নিরাপদ। অনিরাপদ মনে করেন ১৩ শতাংশ মুসলিম ও ৪৬ শতাংশ অমুসলিম তরুণ-তরুণী।
চাকরির বাজারে হতাশা, প্রস্তুতির অভাব : জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২২ শতাংশ কর্মক্ষম যুবশক্তি কর্মে, শিক্ষায় বা প্রশিক্ষণে নেই। মাত্র ৬ দশমিক ২৯ তরুণই মনে করেন তারা ‘ভালভাবে’ বা ‘খুব ভালভাবে’ কাঙ্খিত চাকরির জন্য প্রস্তুত। তাদের মধ্যে অধিকাংশ (৩৭ শতাংশ) তরুণ সরকারি চাকরিকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে করেন। তবে প্রথাগত শিক্ষা তাদের চাকরির জন্য তেমন প্রস্তুত করে না বলেই বেশিরভাগ (৫৩ দশমিক ৯) তরুণ মনে করেন।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি : শুধু ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ তরুণ গত এক বছরে বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। তবে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বলেছেন এটি ‘কিছুটা’ বা ‘খুব’ কার্যকর ছিল। কম্পিউটার, হস্তশিল্প, বৈদ্যুতিক কাজ এবং বিদেশি ভাষা শেখার প্রশিক্ষণ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
‘গণপিটুনি’তে উদ্বেগ ৭১ শতাংশ তরুণের : জরিপে অংশ নেওয়া তরুণের ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ মনে করে, গণপিটুনি এখন প্রায় নিয়মিত একটি সামাজিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। তাদের চোখে এটি একটি বেড়ে চলা সমস্যা, যা শুধু আইনের দুর্বল প্রয়োগ নয়, বরং বিচারহীনতার বহিঃপ্রকাশও। এ ছাড়া প্রতিবেদনে আগুন লাগানো, ডাকাতি ও চুরির মতো ঘটনায় ৮০ শতাংশ তরুণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।