ব্রিটেনের ঠান্ডা ও বৈরী আবহাওয়ায় বাংলাদেশি শাকসবজির চাষ অসম্ভব বলেই মনে করা হতো। কিন্তু এখন সেই অসম্ভবই সম্ভব করে চলেছেন তিনজন প্রবাসী বাংলাদেশি যুবক। তিন বন্ধু কুমিল্লার হাবিবুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাক এবং নওগাঁর ইমদাদ উল্লাহ মিলে গড়ে তুলেছেন ‘ফ্রেশ কৃষি’ নামে শাকসবজি চাষের অনন্য ব্যবস্থাপনা। লন্ডনের উপকণ্ঠে ইপিং এলাকায় ৩ হেক্টর জমির গ্রিনহাউসে তাঁরা চাষ করছেন বাংলাদেশি লাউ, লাল শাক, পুঁই শাক, ডাঁটা, কলমি, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ ও শিমের মতো পরিচিত সবজি। গ্রিনহাউস প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁরা শুধু গ্রীষ্মকাল নয়, সাত-আট মাসজুড়ে এসব শাকসবজি উৎপাদন করছেন।
উদ্যোক্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার কেজি ফসল তাঁরা উত্তোলন করছেন এবং সরাসরি পৌঁছে দিচ্ছেন পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত হোয়াইটচ্যাপেল ও গ্রিন স্ট্রিটের বাজারে। তাঁদের এ বছরের লক্ষ্য প্রায় ৩ লাখ পাউন্ড মূল্যের সবজি বিক্রি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশি সবজির ব্রিটিশ বাজার বিশাল। শুধু ব্রিটেনেই এর বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সে বাজারেই প্রথমবারের মতো ব্রিটেনে বাণিজ্যিকভাবে শাকসবজি চাষ শুরু করেছেন তাঁরা।
ইতালিতে শুরু, ব্রিটেনে সফলতা : ফ্রেশ কৃষির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হাবিবুর রহমান জানান, ২০০৩ সালে জীবনের পরিবর্তনের আশায় তিনি ইতালি যান। সেখানেই কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন। ইউরোপের নানান দেশে সবজি সরবরাহ করতেন। পরে ব্রেক্সিটের সময় ব্রিটেনে চলে আসেন। তিনি জানান, ব্রিটেনে সহজ ছিল না কিছুই। জমির খোঁজ, অনুমতি, গ্রিনহাউস সবই ছিল চ্যালেঞ্জিং। শুরুটা হয় একটি ছোট, ভাঙা গ্রিনহাউসে। প্রথম বছর প্রকল্পটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। হাবিব বলেন, ‘ব্রিটেনের আবহাওয়া সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। গ্রিনহাউস প্রযুক্তিও জানা ছিল না। তাই প্রথম বছরই লস খাই।’ তবে হাল ছাড়েননি তাঁরা। ২০২৪ সালে হারলো এলাকায় ৩ হেক্টরের একটি গ্রিনহাউস খুঁজে পান। পুঁজি কম তাই হাতে চালানো একটি ট্রাক্টর নিয়ে দিনরাত খেটে শুরু করেন চাষ। সেই পরিশ্রমই ফল দেয়। প্রথম বছরেই ১ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডের সবজি বিক্রি।
তাজা, জৈব আর দেশি স্বাদের শাকসবজি : ইমদাদ উল্লাহ বলেন, ‘ব্রিটেনে যেসব বাংলাদেশি শাকসবজি পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগই ইতালি থেকে আসে। দূর থেকে আসায় অনেকটাই নষ্ট হয় বা সতেজতা হারায়। আমরা চাই মানুষ যেন প্রতিদিন তাজা লাল শাক, পুঁই শাক বা কলমি শাক খেতে পারে। একেবারে মাঠ থেকে তোলা সবজি।’ তাঁদের ফার্মে ব্যবহৃত প্রতিটি বীজ আনা হয় বাংলাদেশ থেকে। আর সবজি চাষে ব্যবহার করা হয় কেবল জৈব সার। পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে এ উৎপাদন তাঁদের আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে। তিন তরুণ উদ্যোক্তার বিশ্বাস, বাংলাদেশি সবজির বিশাল বাজারে আরও অনেকে আসবেন। ‘আমরা সফল হয়েছি, কিন্তু এখানেই থেমে থাকব না,’ বলেন আবদুর রাজ্জাক। ‘নতুন যাঁরা বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষ করতে চান, আমরা তাঁদের সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’ তাঁদের এ যাত্রা শুধু অর্থনৈতিক সফলতার গল্প নয়, এটি প্রবাসে দাঁড়িয়ে দেশি শিকড় আঁকড়ে ধরার, হার না মানা পরিশ্রমের, আর স্বপ্ন বাস্তব করার অনন্য আয়োজন।