একের পর এক রেলস্টেশনে অগ্নি সংযোগ ঘটানো, রেল কর্মীদের মারধর, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া, টিকিট কান্টারে হামলা, লুট। কোথাও আবার যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে বাস ভাঙচুর। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (ক্যাব) নিয়ে প্রতিবাদের নামে গত তিন দিন ধরে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের বিক্ষোভকারীদের এই তাণ্ডবের ছবি দেখে এখনও শিউরে উঠছেন অনেকেই।
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হতে হবে ঠিক কথাই-কিন্তু তার জন্য যদি রাস্তাতেই বেঘোরে প্রাণ যায়! এই আতঙ্কের জেরে সপ্তাহের দুই দিন (সোম, মঙ্গলবার) রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে যাত্রীসংখ্যা অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা কম। নিত্যদিন অফিসের তাড়ায় ট্রেনে যে পরিমাণ যাত্রী যাওয়া আসা করেন-হঠাৎ করেই সেই ট্রেন-বাস অনেকটাই ফাঁকা।
গত শুক্রবার মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা স্টেশনে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয় স্টেশন মাস্টারের ঘরে। ভাঙচুর চালানো হয় টিকিট কাউন্টার ও রেল পুলিশের চেকপোস্টে। গোটা স্টেশন চত্ত্বরজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ট্রেনের টিকিট, রেল পুলিশের সদস্যদের ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম। মারমুখী জনতা যেভাবে লাঠি-সোটা হাতে নিয়ে রে-রে করে তাণ্ডব চালায় তা যেন এখনও চোখের সামনে ভাসছে বেলডাঙা স্টেশনে কর্তব্যরত এক রেল পুলিশ কর্মকর্তা গৌরীশঙ্কর দাসের।
তিনি জানান, আমাদের পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল এসে পরিদর্শন করে গেছেন। খুব শিগগিরই আমাদের অফিসটাকে চালু করার চেষ্টা করছেন। বিছানা, খাট সবকিছুতেই আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তার অভিমত, আমরা সে দিন কোন রকমে প্রাণে বাঁচতে পেরেছি।
পরপর কয়েকদিন সহিংসতার জেরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষতির মুখে পড়েছে রেল। পূর্ব রেল সূত্রে দাবি, তাদের প্রাথমিক অনুমান ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি রুপি। এর পাশাপাশি পূর্ব রেলের দাবি ৬২টি কোচে আগুন দেয়া ও ভাঙচুর হয়েছে। ভাঙুচার চালানো হয়েছে ১৫টি স্টেশনে। এরই প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বাবদ পূর্ব রেল আরও অতিরিক্ত ৮টি কোম্পানি রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স (আরপিএফ) চেয়ে পাঠিয়েছে।
পূর্ব রেলের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা নিখিল চক্রবর্তী জানান, এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে যা হিসাবে আছে তাতে ১৫টা স্টেশনে বিশ্রি রকমের ভাঙচুর হয়েছে।
দক্ষিণ পূর্ব রেল সূত্রে দাবি, কেবলমাত্র ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর তাণ্ডবের জেরে তাদের ক্ষতির পরিমাণ ১৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭৯ রুপি। খড়গপুর থেকে হাওড়ার মধ্যে ৬টি স্টেশনে ভাঙচুর কবা হয়েছে। এই তিনদিন রেলের যা ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত পূরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন রেলের সাবেক কর্মকর্তারা।
রেলের সম্পত্তি নষ্টের ফলে যেমন যাত্রী দুর্ভোগ বেড়েছে তেমনি এর প্রভাব পড়েছে পর্যটন ব্যবসাতেও।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলোতে ট্রেন পরিষেবা বন্ধ রেখেছে পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ।
নিখিল চক্রবর্তী জানান, মালদহের পর থেকে আরও কোন ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। রেলের পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। যদিও শহরতলিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিকই থাকছে।
নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস ওড়িষ্যায় পর্যটনের সেরা সময়। এসময় বহু পর্যটক পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের রাজ্য থেকে পুরীতে ভ্রমণ করতে যান। কিন্তু ট্রেন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকরাও তাদের ট্রিপ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল পাস এবং পরে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের ফলে ইতিমধ্যেই তা আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইনের ফলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম (হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পার্সি) ধর্মালম্বীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া হবে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়ার বিরোধীতা করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টির মতো দলগুলো।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত