শিক্ষার মাধ্যমে অজানাকে জানা এবং জানা বিষয়কে কাজে লাগিয়ে অজানার সন্ধান করার যোগ্যতা শুধু মানুষের আছে। ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনের প্রথম নির্দেশনা হলো ‘পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১)
ইসলামে দ্বিনি শিক্ষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি আছে জাগতিক শিক্ষার গুরুত্ব।
পার্থিব প্রয়োজন পূরণ, সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য জাগতিক শিক্ষা অতি জরুরি। কিন্তু মুসলমান হিসেবে জীবনের সব কাজ ইসলামের বিধান মোতাবেক করার জন্য দ্বিনি শিক্ষার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে কতটুকু দ্বিনি শিক্ষা গ্রহণ করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি?
এ বিষয়ে মূল কথা হলো দ্বিনের মৌলিক বিশ্বাস, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সব মুসলমানের ওপর ফরজ। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২২৪; সহিহুল জামে, হাদিস : ৩৯১৩ ও ৩৯১৪)
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আব্দিল বার (রহ.) লিখেছেন, ‘আলেমরা এ কথায় একমত যে এক ধরনের ইলম রয়েছে, যা ফরজে আইন, যা প্রত্যেক মুসলিমকে শিখতে হবে। আরেক ধরনের ইলম আছে, যা শেখা ফরজে কিফায়াহ বা সমষ্টিগত ফরজ। কোনো স্থানের কেউ একজন তা শিখলে ওই স্থানের সব বাসিন্দার ওপর থেকে ওই ফরজ রহিত হয়ে যাবে। (জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি : ১/৫৬)
যে ধরনের ফরজে আইনমূলক জ্ঞান অর্জন করা সব মুসলমানের জন্য ফরজ, তার ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ফরজে আইন ইলম হলো—১. ঈমানের মূলনীতি জানা, ২. ইসলামী শরিয়তের ইলম।
যেমন—অজু, সালাত, সিয়াম, হজ ইত্যাদি, ৩. ইসলামের হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর জ্ঞান, ৪. মুআমালাত (লেনদেন) ও মুআশারাতের (সামাজিকতা) ইলম। (ফাজলুল ইলম ওয়াল উলামা, পৃষ্ঠা : ৩০-৩১)
ইমাম নববী (রহ.) তাঁর ‘রওজাতুত তালেবিন’ গ্রন্থে লিখেছেন, কিছু বিদ্যার্জন ফরজে আইন এবং কিছু বিদ্যার্জন ফরজে কিফায়াহ। দ্বিনের যেসব বিষয় ব্যক্তির ওপর ফরজ সেগুলো কার্যকর করার জন্য যেসব বিদ্যা জানা প্রয়োজন সেগুলো অর্জন করাও ফরজে আইন।
যেমন—অজু, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি। কেননা যিনি সালাতের শর্ত ও রুকন জানবেন না, তার পক্ষে সালাত আদায় করা সম্ভব হবে না।
এখানে শুধু বাহ্যিক বা দৃশ্যমান হুকুম-আহকাম জানার কথা বলা হচ্ছে। সেসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বা খুঁটিনাটি মাসআলা-মাসায়েল নয়, যা সাধারণ মানুষের জানার দরকার পড়ে না।
একইভাবে যদি তার জাকাত দেওয়ার মতো সম্পদ থাকে, তবে তাকে জাকাতের বাহ্যিক বিধি-বিধান জানতে হবে।
আর যিনি বেচাকেনা তথা ব্যবসায়ে জড়িত তাঁকে ব্যবসায়ের বিধি-বিধান জানতে হবে। এভাবে যিনি যে পেশায় যুক্ত তাঁকে সেই পেশার মাসআলা-মাসায়েল জানতে হবে। (আন-নববী, রওজাতু তালেবিন ওয়া উমদাতুল মুফতিন : ১০/২২৩)
আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুকাল্লাফ (ইসলামের বিধান যার জন্য প্রযোজ্য) মুমিন নর-নারী দ্বিন ও হেদায়েতের ইলম (ঈমানসংশ্লিষ্ট জ্ঞান) অর্জন করার পর তার ওপর অজু, গোসল, নামাজ ও রোজার বিধি-বিধান, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে জাকাতের বিধান, হজ ফরজ হলে হজের বিধান শেখা ফরজ।...ব্যবসায়ীদের জন্য ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান শেখা আবশ্যক, যাতে তারা লেনদেনের ক্ষেত্রে সংশয়পূর্ণ ও মাকরুহ বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকতে পারে।
অনুরূপভাবে পেশাজীবীদের এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যে কাজ করে সেটার জ্ঞান ও বিধান জানা তার ওপর আবশ্যক, যাতে সে ওই কাজে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে পারে।’ (আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাহ : ৩০/২৩৯)
তাই প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নিজ নিজ পেশাসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। কেননা এর সঙ্গে তাঁর নিজের ও অন্যের হক এবং তার জীবিকার হালাল বা হারাম হওয়ার প্রশ্ন জড়িত। যেমন—যে ব্যক্তি ব্যবসা করে তার জন্য ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান জানা ফরজ, যাতে সে নিজের অজান্তে কোনো হারাম লেনদেন অথবা সুদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। উমর (রা.)-এর একটি উদ্ধৃতি থেকে বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজারে শুধু সে ব্যক্তি ব্যবসা করতে পারবে যে দ্বিনি জ্ঞানে প্রজ্ঞা অর্জন করেছে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৪৮৭)
পরিশেষে যে ব্যক্তি যে কাজ করে সেটার জ্ঞান ও ইসলামী বিধান জানা তার ওপর আবশ্যক; যাতে সে ওই কাজে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে পারে।