বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

লাশটি ছিল পুলিশের

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশটি ছিল পুলিশের

গাজীপুর ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ৪ নম্বর গেটের সামনে এক যুবকের গলাকাটা লাশ পড়ে আছে। সকাল ৭টায় পথচারীদের নজরে এলে হইচই শুরু হয়। খবর পেয়ে পুলিশও পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে। লাশ উদ্ধারে মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি পড়ে থাকে সেখানেই। কিন্তু পরিচয় মিলে না আনুমানিক ৩২ বছরের অজ্ঞাত সেই যুবকটির। চার দিন পর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গাজীপুর মহানগরীর পূর্ব চান্দনা কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে দাফনের আগে পিবিআই ও র‌্যাব হতভাগ্য যুবকের আঙুলের ছাপ রেখে দেয় তার পরিচয় জানার জন্য। দাফনের চার দিন পর পিবিআই হতভাগ্য সেই যুবকটির পরিচয় জানতে পারে। লাশের ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে নিহত যুবকের পরিচয় শনাক্ত হয়। তার নাম শরীফ আহামেদ (৩৩)। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ঝিলকি এলাকার মো. আলাউদ্দিন ফকিরের ছেলে। পুলিশ আরও জানতে পারে, শরীফ আহামেদ একজন পুলিশ কনস্টেবল। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে প্রায় ছয় মাস ধরে কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। তার বাবা আলাউদ্দিন হোসেনও একজন পুলিশ সদস্য। তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা শহর ফাঁড়িতে কনস্টেবল পদে কমর্রত আছেন। অজ্ঞাত লাশের এমন পরিচয় জানার পর পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনাটি ২০২০ সালের মার্চের। এরই মধ্যে গাজীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য আবেদন করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে শনাক্তের পর তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কারা শরীফকে খুন করল এই প্রশ্ন পুলিশের প্রতিটি সংস্থায়। পুলিশের প্রতিটি বিভাগই এর তদন্ত শুরু করে। র‌্যাবের একটি দল গোয়েন্দা তথ্যে গোপন সংবাদে জানতে পারে, খুনের মূলহোতা গাজীপুরের শ্রীপুর গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করে আছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে দলটি ১৪ মার্চ রাতে খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং হত্যাকারী মো. মোফাজ্জল হোসেনকে গ্রেফতার করে। জেরার মুখে সে তার সহযোগীদের নাম ফাঁস করে। র‌্যাব ময়মনসিংহের তারাকান্দা এলাকা থেকে মাসুদ মিয়া ও মনির হোসেন নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করে। পরে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত তাকওয়া পরিবহনের একটি বাস (গাজীপুর-জ-১১-০১৭৫), রক্তমাখা গাড়ির হুইল রেঞ্জ, একটি চাকু এবং শরীফের তিনটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। তারা পুলিশকে জানায়, পুলিশ কনস্টেবল শরীফ আহম্মেদের সঙ্গে মোফাজ্জল ও গাজীপুরের তাকওয়া বাসের চালক মনিরের পরিচয় ছিল। কিছুদিন আগে কনস্টেবল শরীফের সঙ্গে তাদের দ্বন্দে¡র সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে মোফাজ্জল এবং মনির দুজনে শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ মার্চ তারা কনস্টেবল শরীফকে খুন করার জন্য মোফাজ্জল তার ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়ির দুঃসম্পর্কের আত্মীয় কুখ্যাত ভাড়াটে খুনি মাসুদকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে খুনের চুক্তিতে ভাড়া করে এবং তাকে অগ্রিম ৫ হাজার টাকা দেয়। ২ মার্চ খুনের চুক্তি অনুযায়ী তারা মাসুদকে গাজীপুরে নিয়ে আসে এবং মনিরের বাসায় বসে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন ৩ মার্চ দুপুরে তাকওয়া বাসের ড্রাইভার মনির ৯৯ টাকার মার্কেট থেকে একটি চাকু কিনে মাসুদকে দেয় শরীফকে খুন করার জন্যে। ৩ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় মোফাজ্জল কৌশলে কনস্টেবল শরীফকে ভোগড়া বাইপাস এলাকায় নিয়ে আসার পর তাকে তাকওয়া পরিবহনে উঠিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ড্রাইভার মনির হোসেন বাসটিকে চালিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে শ্রীপুরের মাওনার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং জয়দেবপুরের ভবানীপুর বাজার থেকে ইউটার্ন নিয়ে পুনরায় চান্দনা চৌরাস্তার দিকে যেতে থাকে। পথিমধ্যে চলন্ত বাসের ভিতর আসামিদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। ৪ মার্চ রাত আনুমানিক দেড়টায় বাসটি গাজীপুর হোতাপাড়া আসার পর মাসুদ বাসটিতে থাকা বাসের লোহার হুইল রেঞ্জ দিয়ে পিছন থেকে শরীফের মাথায় পর পর বেদম আঘাত করে। ফলে শরীফের মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকলে, সে অজ্ঞান হয়ে গাড়ির মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। মোফাজ্জল ও মাসুদ দুজনে মিলে নাইলনের রশি দিয়ে প্রথমে শরীফের দুই হাত বেঁধে গাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে যায় এবং মোফাজ্জল শরীফের বুকের ওপর বসে এবং ভাড়াটে খুনি মাসুদ চাকু দিয়ে শরীফের গলাকেটে জবাই করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর শরীফের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা তিনজনে ভাগাভাগি করে নেয়। রাত আনুমানিক ২টায় বাসটি ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের ন্যাশনাল পার্কের ৪ নম্বর গেটের সামনে পৌঁছালে বাসটি থামিয়ে ড্রাইভার মনিরসহ তিনজনে মিলে লাশটি রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় মাসুদ রক্তমাখা চাকুটি রাস্তার পাশে ন্যাশনাল পার্কের ঝোপের দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। এরপর তারা তিনজন বাসন এলাকায় মাম সিএনজি পাম্পের সামনে রাত আনুমানিক আড়াইটায় পাম্পের পানি দিয়ে গাড়ির রক্ত ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে। তাদের রক্ত মাখা জামা-কাপড় পলিথিন ব্যাগে করে গাড়ির টুলবক্সের ভিতর রেখে দেয়। মনির তার নাওজোরের ভাড়া বাসা থেকে মোফাজ্জল ও মাসুদের জন্য পরিষ্কার লুঙ্গি গেঞ্জি নিয়ে আসে এবং তারা তিনজন গোসল করে রাতের খাবার খেয়ে একসঙ্গে মনিরের বাসায় রাত কাটায়। ৪ মার্চ সকাল আনুমানিক ৬টায় ড্রাইভার মনিরসহ তিনজন গাড়িটি নিয়ে কোনাবাড়ী সার্ভিসিং-এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। তাদের রক্তমাখা জামা-কাপড়গুলো গাড়ির টুলবক্স থেকে বের করে কড্ডা ব্রিজের নিচে গভীর পানিতে ফেলে দেয়। পরে মাসুদ তার বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দায় চলে যায়। মোফাজ্জল ও মনির তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগদান করে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর