আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই প্রশাসনে নানারকম রদবদল চলছে। পাশাপাশি নতুন মুখ আসছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। অনেকেই বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগ করছেন। আবার সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন ও চাপ দিয়ে অনেকেই নিজেদের পদোন্নতিও হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অন্যান্য সেক্টরেও এখন রদবদলের ঝড় বইছে। অন্যদিকে চাকরিতে বৈষম্য দূর করতে কিংবা পুরনো চাকরি ফেরত পেতেও নানা ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে।
চুক্তিতে নিয়োগ পাঁচ সচিব এবার সিনিয়র হলেন : কয়েক বছর আগে অবসরে যাওয়া পাঁচজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রথমে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সচিব হওয়া ওই পাঁচজনকে গতকাল সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর এক দিন আগে শনিবার চাকরিজীবনের অবসরের কয়েক বছর পর তাদের পুনরায় চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্তরা হলেন- মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আবদুর রশিদ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মো. এহছানুল হক, জননিরাপত্তা বিভাগে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের জনবিভাগে ড. নাসিমুল গণি এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হয়েছেন এম এ আকমল হোসেন আজাদ। উল্লেখ্য, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অতিরিক্ত সচিব থেকে অবসরে যান। কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল।
যুগ্মসচিব পদোন্নতি পেলেন ২০১ জন : প্রশাসনে পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ ১১৭ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতির পর এবার যুগ্মসচিব পদে ২০১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৪১ জন কর্মকর্তা অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা থেকে ডিএস পুলে উপসচিব হয়েছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদবঞ্চিতরা পদোন্নতির জন্য আন্দোলন করে আসছিলেন। যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিয়ে গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যে তারিখ থেকে এই কর্মকর্তাদের কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা তাদের ছাড়িয়ে যান, সেই তারিখ থেকে তাদের পদোন্নতি কার্যকর হবে এবং তারা বকেয়া আর্থিক সুবিধা পাবেন। এর আগে ১৩ আগস্ট উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিল সরকার। যুগ্মসচিবদের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর অথবা ইমেইলে যোগদানপত্র জমা দিতে পারবেন। পদোন্নতির আদেশে উল্লিখিত কর্মস্থল থেকে কোনো কর্মকর্তার দপ্তর বা কর্মস্থল ইতোমধ্যে পরিবর্তন হলে কর্মরত দপ্তরের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে যোগদানপত্র জমা দিতে হবে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পরে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনোরকম বিরূপ বা ভিন্নরূপ তথ্য পাওয়া গেলে তার ক্ষেত্রে এ আদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন বা বাতিল করার অধিকার কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর থেকে সচিবালয়ে পদ-পদোন্নতি থেকে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এসব নিয়ে প্রায় প্রতিদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সচিবালয়ে জড়ো হয়ে নিজেদের দাবি জানাচ্ছেন। এরকম প্রেক্ষাপটের মধ্যে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক আদেশে গতকাল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মো. জাহিদুল ইসলাম। আর ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের পিএস নিয়োগ পেয়েছেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক ছাদেক আহমদ। আরেক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয়েছে।
ডিআইজি পদোন্নতি পেলেন ৭৩ পুলিশ কর্মকর্তা : বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক) থেকে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৭৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে ৬৩ জনকে সুপারনিউমারারি হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ-১ শাখা থেকে জারি করা পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে এ পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব বরাবর যোগদান করবেন এবং পরবর্তী পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত স্ব স্ব পদে বহাল থেকে দায়িত্ব পালন করবেন।
স্বাস্থ্য খাতে রদবদল : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব এম কে হাসান জাহিদ স্বাক্ষরিত আরেক প্রজ্ঞাপনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন।
এ ছাড়া পদত্যাগ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসেছেন তিনি। গতকাল উপাচার্য ছাড়াও বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমানও পদত্যাগ করেছেন। চলতি বছরের ১১ মার্চ অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হককে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমান পদত্যাগ করেছেন। গতকাল তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগের আবেদন করেছেন। এদিকে গতকাল বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মরত ১২ জন ডাক্তারকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ঢাকার সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে প্রেষণে নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পদত্যাগ করলেন বুয়েটের উপাচার্য, বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার পদত্যাগ করেছেন। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করছেন। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন।
২০২০ সালের ২৫ জুন প্রথম মেয়াদে বুয়েটের ১৪তম উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সত্য প্রসাদ মজুমদার। গত ২৬ জুন ছিল তার প্রথম মেয়াদের শেষ কর্মদিবস। এরপর তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদত্যাগপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। চার বছরের জন্য তাকে বিএসইসির চেয়ারম্যান করে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
সচিবালয়ের গেটে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে সাবেক বিডিআর সদস্যদের বিক্ষোভ : পিলখানা হত্যাকান্ডের পর চাকরিচ্যুত সাবেক বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) ৭৬তম ব্যাচের সদস্যরা পুনরায় চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে এ দাবি নিয়ে বিকালে সচিবালয়ের গেটে বিক্ষোভ করেন। এ সময় চাকরিচ্যুত সাবেক বিডিআর সদস্যরা বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিতে এসেছি। আমরা ৭৬তম ব্যাচের ৫১৬ জন সদস্য বাংলাদেশ রাইফেলসের সর্ব কনিষ্ঠ ব্যাচ ছিলাম। যে ব্যাচটি ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রামে অবস্থিত রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং শুরু করি। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস হেডকোয়ার্টার পিলখানায়-বিডিআর বিদ্রোহের নামে একটি অপ্রত্যাশিত নীরব হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল।
স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিবকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা : সচিবালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিবকে অবরুদ্ধের চেষ্টা করেছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বঞ্চিত কর্মকর্তারা। তবে কৌশলে অফিস থেকে বের হয়ে যান সচিব। গতকাল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা সচিবালয়ের গেটে শতাধিক কর্মকর্তা ব্যানার ও জাতীয় পতাকা নিয়ে অবস্থান করেন। পরে বৈষম্য নিরসনে বেলা ১১টার দিকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিষয় উল্লেখ করে স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপি প্রদান শেষে কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমানের কক্ষে গেলে সচিব মিটিংয়ে রয়েছেন জানিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যান। কর্মকর্তারা তাদের পদোন্নতির বিষয়ে কথা বলার জন্য সময় চাইলেও তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সচিব তার কক্ষ থেকে কৌশলে বেরিয়ে পড়েন এবং বেলা ৪টায়ও তিনি কক্ষে আসেননি। এ সময় ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সচিবের একান্ত সচিবসহ অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন), অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন), যুগ্মসচিব (প্রশাসন)-কে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা সচিবের কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় সচিবকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন স্লোগান দেন এবং তার অপসারণ চান।