২১ এপ্রিল, ২০২১ ২৩:৫৮

‘বিলেতি সৌরভ’ গায়ে মাখার আনন্দ

মোহাম্মদ আব্দুস সবুর

‘বিলেতি সৌরভ’ গায়ে মাখার আনন্দ

হুসেইন ফজলুল বারীর ‘বিলেতি সৌরভ’ গ্রন্থটি পড়ে শেষ করলাম ছোটগল্প পাঠ শেষের অতৃপ্তি নিয়ে। পাঠ শেষ করে মনে হলো লেখক বিলেতে আর কটা দিন বেশি থাকলেই পারতেন। বেশি না হোক পূর্বসূরি লেখকের মতো বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন থাকলে পাঠকেরা আরও দীর্ঘ মানসভ্রমণের সুযোগ পেতো। ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠের একটা সহজাত আকর্ষণ আছে। তাছাড়া দেশ বিদেশ ভ্রমণ করার মুরোদ নেই যাদের তাদের বইয়ের কালো অক্ষরে চড়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন- ‘সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে/অক্ষয় উৎসাহে’। নাম দেখে অনুমান করি এটি একটি ভ্রমণ কাহিনি। সুন্দর প্রচ্ছদ দেখে বইটা হাত তুলে নিই। প্রথমে চোখ বুলাই মলাটভাঁজে  যেখানে বইটি পাঠের উস্কানি থাকে। সেখানে লেখা আছে ‘এটি বিলেত নিয়ে নিছক কোনো ভ্রমণ কাহিনি নয়, বরং এক নিবিষ্ট পাঠক আর মননশীল মানুষের জবানিতে অপূর্ব আখ্যান। রচয়িতার প্রেমের টুকরো টুকরো স্মৃতির ফাঁকে এতে আইনের ইতিহাস, বৃটিশ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি আর স্বদেশি আন্দোলনের খণ্ডচিত্র বৈঠকি ঢঙে মূর্ত হয়ে উঠেছে।’ উস্কানিই বটে- কখন পড়তে শুরু করি সুযোগ খোঁজছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা থেকে রাজশাহী ফেরার পথে অখণ্ড অবসরে বইটি পড়ে শেষ করব। ভ্রমণেই ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ার সুযোগ নিলাম।

শুরুতে লেখক ‘মুখবন্ধ’ লিখে পাঠকের মুখ বন্ধ করতে চাননি। হয়তো এক্ষেত্রে তিনি তপন রায় চৌধুরীকে মান্য করেছেন। যিনি বলেছেন-‘ মুখ খোলাকে মুখবন্ধ বলা নিতান্ত অর্থহীন।’  পরিবর্তে লেখক পাঠকের কাছে ‘সবিনয় নিবেদন’ জানিয়েছেন। সে অংশটুকু পাঠ করে জানতে পারি লেখক যুক্তরাজ্য সরকার প্রদত্ত শেভনিং বৃত্তি পেয়ে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইন  বিষয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। এ উপলক্ষে সেখানে যাপিত তিনশ ষাট দিনের উল্লেখযোগ্য অংশ বইটিতে পরিবেশন করা হয়েছে। সে হিসেবে বইটির নাম ‘বিলেতে তিনশ ষাট দিন’ও হতে পারতো। তা হলে অবশ্য অনুকৃতির কালিমা গায়ে লাগতো। বর্তমান নামটি দেখে পাঠক যদি ভাবেন লেখক কেবল বিলেতের সৌরভ ছিটিয়েছেন তা হলে ভুল করবেন। আমন্ত্রিত হয়ে বিলেত গিয়ে গদগদ হয়ে তিনি স্বাগতিকদের অতীত ইতিহাস বিস্মৃত হননি। ব্রিটিশদের অত্যাচার, লুণ্ঠন ও শঠতার ছবি এঁকেছেন প্রসঙ্গ ধরে। এ বিষয়টি আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। 

একশ বায়ান্ন পৃষ্ঠার বইটি লেখক ষোলোটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছেন। প্রথম ও শেষ অধ্যায়টা বিমানের ওঠা নামার সাথে তুলনীয়। পরিচ্ছেদের নামকরণ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক যেমন- নিঃসঙ্গ সম্রাট, ফুলের জলসা ও দণ্ডি ত মানুষ, সোনালুর পাপড়ি ও কুফাবাসী সাধক, গ্রিক দীপশিখা, শেভনিং বৃত্তি, আইনের তপোবন, সেমিটিক ললনা, তীর্থ, আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, বিলেতি সারমেয়, সুরমার জল, কাটামুণ্ড ও শ্বেতহংসী, বিচারিক খুন, কালো গাউনের বাসিন্দা, পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার ও ফেরা। প্রতিটি নামে এক ধরনের চৌম্বকত্ব আছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদে প্রিয় কোনো কবির পঙক্তিমালা স্বাদবর্ধকের কাজ করেছে। পাশাপাশি এ থেকে লেখকের সাহিত্য পাঠের ভূগোল সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। এটি তাঁর প্রথম বই কিন্তু অলংকার প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় মনে হবে তাঁর লেখালেখির অভ্যাস দীর্ঘদিনের।   

পাঠক বইয়ের ফ্ল্যাপে চোখ বুলালে জানবেন লেখক পেশায় একজন বিচারক আর তাঁর নেশা সাহিত্য পাঠ। ফলে তাঁর দ্রষ্টব্য তালিকায় বিচার সংশ্লিষ্ট স্থাপনা, বিষয় ও ব্যক্তি স্থান পেয়েছে। তবে তিনি কেবল বিচারিক গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকেননি, সাহিত্য দর্শন কোনো কিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। বরং অবাধ আড্ডার মতো এক প্রসঙ্গ থেকে  অন্য প্রসঙ্গে অবলীলায় প্রবেশ করেছেন। যেমন অমিততেজ তরুণ লর্ড মেকলের প্রসঙ্গ এসেছে। তাঁর নেতৃত্বে রচিত অপরাধ ও শাস্তির আকর গ্রন্থ দ্য ইন্ডিয়ান পিনাল কোড  ১৮৬০, যা এখনও ভারত উপমহাদেশের বাইরে পৃথিবীর একাধিক দেশে অনুসৃত হয়। মেকলে’র আলোচনা সূত্রে প্রসঙ্গক্রমে আসে ক্ষয়িষ্ণু মোগল সাম্রাজ্যের নামমাত্র শাসক সম্রাট বাহাদুর শাহের করুণ পরিণতির কথা। লেখক নীতিহীন ব্রিটিশ বেনিয়াদের শঠতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, রাজ অমাত্যগণের বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজকুমারদের অপরিণামদর্শী আচরণ সম্পর্কে তুলির আঁচড় দিয়েছেন। বাদ যায়নি সিপাহি বিদ্রোহের প্রসঙ্গ।

এসেছে বিচারিক খুনের কথা। ব্রিটিশদের প্রথম বিচারিক খুনের বলি হন ব্রাহ্মণ নন্দকুমার। সাহিত্যরসিক লেখক বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি মীর্জা গালিবকে এড়িয়ে যান কী করে। ‘নিজের চেহারা না ধুয়ে সারাজীবন শুধু আয়না পরিষ্কার করে যাওয়া’ মীর্জা গালিবকে লেখক হাজির করেছেন পরম মমতায়। স্থানে স্থানে তাঁর কাসিদা-শের ব্যবহার করে লেখক পাঠককে টানা গদ্য পড়ার যতি দিয়ে স্বস্তি দিয়েছেন। অন্য একটি পরিচ্ছেদে তিনি কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাশি দেশের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। তাদের সঙ্গে পরিচয় পর্বে লেখক তাদের নিজ নিজ দেশের বিচার ব্যবস্থা বৈঠকি ঢঙে তুলে ধরেছেন। দিনারা নামক এক ইরাকি তরুণীর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক পাঠককে নিয়ে যান অষ্টম শতকের সমৃদ্ধ বাগদাদে। আলোচনা করেছেন হানাফি মাজহাবের প্রবক্তা ইমাম আবু হানিফার কথা যাঁর মতবাদ ভারতবর্ষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গ্রিক দীপশিখা পরিচ্ছেদে এথেন্সবাসী এক অধ্যাপকের বয়ানে সক্রেটিস জীবন্ত হয়ে ওঠেন। 

মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সত্যের প্রতি সক্রেটিসের অবিচলতা একদিকে পাঠককে উদ্দীপ্ত করবে অন্যদিকে তাঁর করুণ মৃত্যুতে পাঠক তিন সহস্রাব্দের ব্যবধান ভুলে স্বজন হারানোর কষ্ট অনুভব করবেন। শেভনিং বৃত্তি পরিচ্ছেদে লেখক আইনজীবী জীবন এবং পরবর্তীকালে বিচারকজীবনের অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়েছেন। এ অংশে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মহাত্মা গান্ধী, ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ব্যারিস্টার জহরলাল নেহেরুর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ভুলে যাননি ব্যারিস্টার মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। লেখক ব্যারিস্টারের তালিকায় নতুন একজন ব্যারিস্টারের শেষের দিকে দৃশ্যপটে হাজির হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। একটি পরিচ্ছেদে লেখক আইন বিভাগে তাঁর শিক্ষাগুরুদের সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। 

তরুণ প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায় এক সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে লেখকের দেখা হয়ে যায় ঘটনাচক্রে। অনেকেই ‘আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা’ গানটি শুনেছেন কিন্তু এর শিল্পী নাহিদ নিয়াজিকে ভুলতে বসেছেন। এ বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিচ্ছেদ ‘বিলাতি সারমেয়’। বিলেতি কুকুর নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ এ লেখাটি  নিঃসন্দেহে পাঠকদের ভালো লাগবে। ব্রিটিশদের পশুপাখিপ্রীতি লেখকের নজর কেড়েছে এবং তিনি এর প্রশংসা করেছেন। 

পাঠক হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে এই ব্রিটিশরাই আবার গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অজুহাতে একটি প্রাচীন সভ্যতার ধারক জনপদ ও নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যায় দোসরতা করে। এই পরিচ্ছেদের শেষের দিকে লেখক রবার্ট ক্লাইভের বাড়ি দেখার কথা লিখেছেন। গুণমুগ্ধ চার্চিল তার বাড়ির সামনে ফলকে লিখে রেখেছেন- Here lived Clive of India। লেখক এ নিয়ে খুব রসিকতা করেছেন। 

এ নিয়ে কৃতজ্ঞ চার্চিলকে দোষ দেওয়া যায় না কেননা তিনি যে সমৃদ্ধির চূড়ায় আসীন তার সিংহভাগ সম্পদ ক্লাইভ লুট করে এনেছেন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে। এতো বড়ো মানুষ কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকলে হয়! লুট শব্দটা তাদের এতো প্রিয় হয়ে যায় যে  অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ইংরেজি শব্দ হিসেবে তা ভুক্ত হয়। এ পরিচ্ছেদে রাজশ্রী নামের লেখকের এক সহপাঠিনীর উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়। লেখক তাকে যেভাবে এই গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন অনেকের সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ এর মার্গারিটের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। অন্য একটি পরিচ্ছেদে পাঠক খুঁজে পাবেন স্যুট টাই পরে বসে থাকা জেরেমি বেন্থামকে। বাংলা ভাষায় বই লেখা হবে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা কি হয়! ঠাকুর এখানেও আছেন, কেবল সাহিত্য প্রসঙ্গ হয়ে নয় একেবারে আবক্ষ ভাস্কর্য হয়ে। রবীন্দ্র সাহিত্যে বিচার ও আদালত প্রসঙ্গ থাকায় পেশায় বিচারক লেখক ভালোবাসার সমন জারি করে এখানে সসম্মানে নিয়ে এসেছেন। হাজির হয়েছেন মার্ক্সও;  কতসব কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি, তবু নিয়মিত সময় করে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে বসতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এবার ‘ফেরা’র পালা। যথানিয়মে লেখক দেশে ফিরেছেন। প্রবাসে থাকাকালীন মায়ের কাছে ফেরার, মাটির সোঁদা গন্ধ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। বিমানে চেপে তাঁর আর তর সইছিল না। বিমান বন্দরে পা রেখেই সাদা আলখাল্লা পরা পিতার বুকে আছড়ে পড়ে লেখক পেয়েছেন অনিঃশেষ সৌরভ।  

বিলেতি সৌরভের চেয়ে বাংলার সৌরভ যে অনেক মোহনীয় এই সত্য পূর্বসূরিদের মতো তাঁর লেখাতেও ফুটে উঠেছে। আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার সময় বিমান থেকে দেখা এই নোংরা ঢাকা শহরকে হুমায়ূন আহমেদের কাছে ডিজনিল্যান্ডের চেয়েও বেশি মোহনীয় মনে হতো।

বইয়ের পরতে পরতে আছে লেখকের বাগ্বৈদগ্ধ ও সূক্ষ রসবোধের স্বাক্ষর। এই ক্ষুদ্র পরিসরে সব আলোচনা করা সম্ভব নয়। আর সে চেষ্টাও করছি না। কিছু মুদ্রণ ত্রুটি চোখে পড়েছে যা অত্যন্ত ব্যস্ততার কারণে হয়েছে বলে অনুমান করি।। একই কারণে কিছু দীর্ঘ বাক্য রয়ে গেছে যা পাঠকের চোখে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। সূ² রুচির কোনো পাঠক অতিরিক্ত ছবি ব্যবহার নিয়ে অনুযোগ করতে পারেন। এতো ছবি অথচ কেতকী কুশারি ডাইসনের ছবি নেই। 

তিনি ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশে কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় গ্রন্থপঞ্জি জুড়ে না দেওয়ার কথা বলেছেন। তবে আমার মনে হয় এক পৃষ্ঠায় গ্রন্থপঞ্জি জুড়ে দিলে আগ্রহী পাঠকরা বিস্তারিত জানার সুযোগ পেতেন। এসব সত্ত্বেও বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না। বাজি ধরতে পারি! পাঠক, লকডাউনে যেহেতু কোথাও বেড়াতে যেতে পারছেন না সেই ক্ষোভে পড়ে ফেলুন ফরাসি বহুমূল্য সৌরভের চেয়েও দামি ‘বিলাতি সৌরভ’। এক সাহিত্যসভায় সুনীলকে লেখক প্রশ্ন করেছিলেন সাহিত্য রচনায় তিনি কার দ্বারা প্রভাবিত, বিদায় নেওয়ার আগে একই প্রশ্ন তাঁকেও করতে চাই। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক লেখকের গদ্যে কিছুটা সৈয়দ মুজতবা আলীর ছায়া পড়েছে বলে মনে হয়। এই পাঠকের কামনা -স্বমহিমায় ভাস্বর হোন লেখক। 

*পিএইচডি ফেলো, আইবিএস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ শিক্ষক। [email protected]

 

 
 

সর্বশেষ খবর