বুধবার সকাল থেকে পুড়ছে সুন্দরবন। আগুন লাগার পর ৪৮ ঘন্টা পার হলেও শুক্রবার সকালে বনের বিভিন্ন স্থান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এরইমধ্যে পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে বিশাল এলাকার মূল্যবান সকল গাছ। অনেক প্রাণী পুড়ে কয়লা হয়েছে। বাকিরা পালিয়ে গেছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের গহীন অরণ্যে বুধবার সকালে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের আড়ুয়ার খাল সংলগ্ন তুলাতলা- টেংরার বিল এলাকার ২৫ নম্বার কম্পার্টমেন্টে ধরিয়ে দেওয়া আগুন শুক্রবার সকালেও বিক্ষিপ্তভাবে জ্বলতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় চাঁদপাই রেঞ্জ জুড়ে রেড এলার্ড জারি করা হয়েছে। সুন্দরবনের ৪ কিলোমিটার গহীণের এই আগুন লোকালয় থেকেও দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবন বিভাগ আগুন যাতে করে গোটা বনে আরো ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ফায়ার লাইন (অগভীর নালা কেটে পানি ভরে দেয়া) কাটার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের বাগেরহাট, শরণখোলা, মংলা, মোড়েলগঞ্জ ও খুলনার ৫টি ইউনিট বাঘের ভয়কে উপেক্ষা করে বুধবার থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগুন নেভানোর কাজ শেষ করার পর শুক্রবার সকালে ফের ধোঁয়ার কুণ্ডলি ও বিক্ষিপ্ত আগুন চোখে পড়ায় ফের কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস।
সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার ঘটনায় চাঁদপাই রেঞ্জ জুড়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রেড এলার্ড জারি করেছে সুন্দরবন বিভাগ। একই সাথে এই রেঞ্জে সব ধরনের পাশ-পারমিটসহ সম্পদ আহরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনের চাদঁপাই রেঞ্জে এক মাসের মধ্যে ৪ দফা আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ৬ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) মো. মোজাহেদ হোসেনকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, কোষ্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগকে সদস্য রাখা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার কারণ উদঘাটন ও আগুনে বনভূমির প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। এদিকে নাশকতার এই আগুনের ঘটনায় চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ মো. বেলায়েত হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ। ডিএফওর গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে তদন্ত কাজ শুরু করেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট, বনবিভাগ ও স্থানীয় গ্রামবাসী একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে আগুনের ধোয়া উড়তে দখো যাচ্ছে। যেখানেই ধোয়া দেখছে সেখানেই পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছে। প্রচন্ড তাপদাহ ও বাতাসের তীব্রতা থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগুন পুরোপুরি না নেভানো গেলেও তা নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রয়েছে বলে দাবি করেন এই বন কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, গত দু'বারের মতো এবারও সুন্দরবনে যে আগুন লেগেছে তা পরিকল্পিত নাশকতা। স্থানীয় গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত নিজেরা লাভবান হতে সুন্দরবনে আগুন দিয়েছে তা আমাদের প্রাথমিক তনন্তে উঠে এসেছে। এবার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এদিকে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা সুন্দরবন সুরক্ষায় মোটেও আন্তরিক নয়। সুন্দরবনে শুধু অগ্নিকান্ডই নয়, প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ ধরা, বাঘ-হরিণ শিকার ও গাছ পাচারসহ নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ড চলছে যার অধিকাংশই দৃশ্যমান না হওয়ায় মিডিয়াতে আসছে না। আর আগুন লাগার বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়াতে বারবার এটি মিডিয়ায় আসছে। কারা এতে জড়িত তা বনবিভাগের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। তারপরও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য সুন্দরবনকে পুড়িয়ে দিতে পারে, তারা কখনোই দেশের ভালো চায় না। তারা দেশের শত্রু।
সুন্দবন সন্নিহিত পাঁচ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠন ‘সুন্দরবন সাংবাদিক ফোরাম’ এর আহবায়ক মো. মনিরুজ্জামান নসিম আলী ও সদস্য সচিব শেখ আহসানুল করিম সুন্দরবনে বার বার অগ্নিকান্ডে গবীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে লোক চলাচল ও বনের সব ধরণের সম্পদ আহরণ বন্ধ করাসহ এসব দুস্কর্মের সাথে জড়িত সব পক্ষকে দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই বাঁচবে সুন্দরবন।
উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় সুন্দরবনের ১০ একর বনভূমি। ১২ ও ১৮ এপ্রিল- এ দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরনখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১১ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে সুন্দরবন বিভাগ পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে। মামলা হলেও শরনখোলা থানা পুলিশ আওয়ামী লীগের ওই ১১ নেতা-কর্মীর একজনকেও আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি। যাদের নামে মামলা হয়েছে তারা এখনও বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ