বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের পঁচিশ নাম্বার কম্পার্টমেন্টের এলাকায় ধরিয়ে দেয়া নাশকতার আগুন শুক্রবার মধ্যরাতে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শনিবার চতুর্থদিন সকালে কোথাও আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে গত তিনদিনে পুড়ে গেছে প্রায় ২০ একর বন। নাশকতাকারীরা এবার সুন্দরবনের কয়েক কিলোমিটারের এলাকাজুড়ে অন্তত ২০টি স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়া আগুনে একরের পর একর বনাঞ্চলের সাথে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। আগুনে পুড়ে মারা গেছে সামুদ্রিক কচ্ছপও। এলাকাটি দুর্গম এবং পানির সুব্যবস্থা না থাকায় সবাইকে আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটকে।
এদিকে এই আগুন আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় শুক্রবার রাতে খলিলুর রহমান হাওলাদার (৩৫) নামে একজনকে আটক করেছে শরণখোলা থানা পুলিশ।
সুন্দরবনে নাশকতার আগুনের ভয়াবহতা সরেজমিনে পরির্দমনে আজ শনিবার দুপুরে আসছেন প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. ইউনুছ আলী। আগামীকাল রবিবার সকালে আসছেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সুন্দরবনে আসছেন। ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ এতথ্য নিশ্চিত করেছে।
বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জহির উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সুন্দরবনে এবারে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনের ধরনটা একটু ভিন্ন। এই দুর্বৃত্তরা তুলাতলা এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০ টি স্থানে আগুন দিয়েছে। যা সনাক্ত করতে সময় লেগেছে। যার কারনে আগুন নিভাতেও সময় লাগছে। তদন্তের পাশাপাশি জিপিএস সিষ্টেমের মাধ্যমে ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকাসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরূপণের কাজ চলছে ।
বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান মানিক শনিবার সকালে জানান, এখন বিভিন্ন এলাকায় আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে উঠছেনা। বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার মধ্য রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট বিরতিহীনভাবে কাজ করে আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে। পানির অভাবসহ প্রখর তাপদাহ ও তীব্র বাতাসের কারনে আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিকে ধানসাগর স্টেশনে স্ট্যান্ডবাই রাখা হচ্ছে।
অপরদিকে এই আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় শুক্রবার রাতে খলিলুর রহমান হাওলাদার (৩৫) নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
শরণখোলা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম মিয়া এতথ্য নিশ্চিত করে জানান, খলিল উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের চান মিয়া হাওলাদারের ছেলে। সুন্দরবনে আগুন দেয়ার ঘটনায় জড়িত এমন তথ্যে ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়েছে।
সুন্দরবনের আগুন ধরিয়ে দেয়ার নেপথ্যে
সুন্দরবনসহ উপকূলের অপরাধ জগতের হাল নাগাদ খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র বলছে, দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেক সময় এক শ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় শাসকদলের কয়েকজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান তাদের দস্যুবাহনী দিয়ে সুন্দরবনে মিঠা পানির মাছের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত ১৮/২০টি বিল কথিত ইজারার নামে অবৈধ্য মাছ চাষ করতে পরিকল্পিত ভাবে বনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
১২ এপ্রিল রাতে এবং ১৮ এপ্রিল সকালে ও সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল ভোরে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী বনে ৩টি আগুনের ঘটনাটি নিয়ে এবার এমনই অভিযোগ তুলেছে খোদ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো.সাইদুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, ১২ এপ্রিল রাতে ও ১৮ এপ্রিল সকালে সুন্দরবনে দেয়া আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ আদালত এবং শরণখোলা থানায় পৃথক দুটি মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। ওই দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরনখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ আসামী স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১১ নেতা-কর্মীদের পুলিশ একজনকেও আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি। ডিএফও জানান, এবারেও যারা সুন্দরবনে পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িত প্রাথমিত তদন্তে ইতোমধ্যে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রবিবার সকালে বাগেরহাটের আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। তবে সুন্দরবনে পরিকল্পিত এসব আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার মাস্টারমাইন্ডদের কেন দ্রুত বিচার আইনের মামলার আসামি করা হচ্ছে না ? সে বিষয়ে নিয়ে কোন সরাসরি কোন মন্তব্য না করে এই বন কর্মকর্তা আরও জানান, বন বিভাগ কাইকে ছাড় দেবে না।
ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে গত ১৪ বছরে এনিয়ে ২২ বার আগুনে পুড়েছে । চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূসি। সর্বশেষ একই এলাকায় মাত্র এক মাসের মধ্যে চতুর্থ বার ২৭ এপ্রিল ভোরে ধরিয়ে দেয়া নাশকতান আগুন তিন দিন পর শুক্রবার মধ্য রাতে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুধুমাত্র বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা এসব আগুনে প্রায় ৭০ একর বন ও পুড়েছে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। সুন্দরবনকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষায় নেই বন বিভাগের কোন নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা। ২০০২ সালের ২২ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড কটকা অভয়ারণ্যের প্রায় পনেরো দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের মধ্য দিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ শুরু হয় অগ্নিকাণ্ড। আগুন লাগানোর এসব দুষ্কর্মের সাথে জড়িত আপরাধীরা সব সময় থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে। গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে কেন বা কোন জাদুবলে শুধুমাত্র চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কিছু এলাকায় একের পর এক আগুন লাগার বিষয়টি এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিডি-প্রতিদিন/ ৩০ এপ্রিল, ২০১৬/ রশিদা