২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:৪৭

মহামারীতে বাল্যবিয়ের হিড়িক

চার গুণ বেড়েছে বাল্যবিয়ে, শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা, কুসংস্কার দারিদ্র্য, স্বল্প যৌতুকে বিয়ে, করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা মূল কারণ

জিন্নাতুন নূর

মহামারীতে বাল্যবিয়ের হিড়িক

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সাবিনা আক্তার। বয়স ১৪। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে ডাক্তার হবে। করোনা মহামারীতে তার সে স্বপ্ন লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অল্প বয়সেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে বিয়ে বন্ধ করতে পারেনি সে। একই দশা কালাই উপজেলার বিয়ালা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আঁখির। তার পরিবারের ধারণা, স্কুল বন্ধ; মেয়ের পড়াশোনা আর হবে না তাই ভালো পাত্র পেয়ে তারা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। করোনাকালে এমন শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধুলায় মিশে গেছে। জীবন থেকে চলে গেছে উচ্ছলতা। আর বিদ্যালয়ে পা পড়বে না তাদের। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন তাদের বিদ্যালয়ে মোট মেয়ে শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশই এখন আর উপস্থিত হয় না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা বাল্যবিয়ের শিকার।

করোনা মহামারীতে ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় দেশব্যাপী বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মহামারীতে প্রায় চার গুণ বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে। তারা বলেন, শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা ও কুসংস্কার, দারিদ্র্য, করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরিবারের কাছে মেয়েরা অনেকটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাশাপাশি ভালো সম্বন্ধ পাওয়ায় কম খরচে ও স্বল্প যৌতুকে বিয়ে দেওয়ার সুযোগও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। এর বাইরে স্কুল বন্ধ থাকায় মোবাইল-ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমের সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে বা বাল্যবিয়েতে পরিণত হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, গোপনে অথবা ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করে ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার মহামারীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি কম থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া করোনার সময় জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে জেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটি বাল্যবিয়ে বন্ধে পর্যাপ্ত অভিযান পরিচালনা না করা এবং অভিযানে পন্ড হয়ে যাওয়ায় বিয়েগুলোর ফলোআপ ও মনিটরিং না থাকায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে।

বাল্যবিয়ের শিকার কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, মত না থাকলেও পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হয়েছে। আর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বিয়ের চাপ বেশি ছিল। বিয়ের পিঁড়িতে বসে অনেকেরই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছে। করোনায় দেশব্যাপী কী পরিমাণ বাল্যবিয়ে হয়েছে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। এ বিয়য়ে যোগাযোগ করা হলে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক (পরিবীক্ষণ সমন্বয় ও সচেতনতা) মো. আবুল কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মহামারীতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কর্মকর্তাদের ডিজি কার্যালয় থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধের বিষয়ে আরও সোচ্চার হতে নোটিস দেওয়া হয়েছে।’

কালাই উপজেলার বিয়ালা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক তোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৫০ শতাংশ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ আগে তিনজন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।’ অভিভাবকরা বলছেন, সংসারে অভাব-অনটন, স্কুল বন্ধসহ পারিপার্শ্বিক কারণে অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তানের বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেক অভিভাবক বলেছেন, দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকায় মানসিকভাবে সন্তানরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এ দেড় বছরে জয়পুরহাটের পাঁচ উপজেলার মধ্যে সোনামুখী বিদ্যালয় থেকে ১৬, কাশিড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২৩, ইটাখোলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২৬ জনসহ জেলার ২৮১টি বিদ্যালয়েই এভাবে আশঙ্কাজনক হারে বিয়ের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা যখন বাসায় অবস্থান করছিল তখন আমরা মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের একটা হিড়িক লক্ষ্য করেছি। অভিভাবকরা মেয়েদের গোপনে বিয়ে দেন তাই আমরা অনেক সময় বাল্যবিয়ের ঘটনা জানতে পারিনি।’

দারিদ্র্যপীড়িত দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ সময় অঞ্চলটির দরিদ্র ও অশিক্ষিত অনেক অভিভাবক কন্যাশিশুদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা ও কুসংস্কারের কারণে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফুলবাড়ী উপজেলায় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ৮৫ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। জানা যায়, দারিদ্র্য, যোগাযোগবিচ্ছিন্নতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য এ উপজেলায় বাল্যবিয়ে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সম্প্রতি ফুলবাড়ীর বড়ভিটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহা. মতিউর রহমান খন্দকার জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে ৩৪৫ শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ৮৫ বালিকার বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি জানান, গত দেড় বছরে তার বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণি ২, সপ্তম শ্রেণির ১১, অষ্টম শ্রেণির ১৭, নবম শ্রেণির ২৮, দশম শ্রেণির ১৪ এবং নভেম্বরে হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়। বড়ভিটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নাছিমা, নূপুর, আতিকা খাতুনসহ অনেকেই জানায়, ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় খোলার দিন এসে দেখে তাদের ১৭ বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমী আক্তার জানায়, তার ক্লাসেরও ২৮ বান্ধবীর বিয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার ওই প্রতিষ্ঠানের নিলুফা ইয়াসমিনের বাবা সাইকেল মেকার বাবলু মিয়া বলেন, ‘বাধ্য হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সাইকেল সেরে যা পাই তা দিয়েই চলে সংসার। তার পরও করোনার সময় অনেক কষ্টে চলতে হয়েছে। মেয়ের ভালো সমন্ধ পাওয়ায় আর দেরি করিনি।’

সাতক্ষীরায়ও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির দেওয়া তথ্যমতে করোনার এই সময়ে জেলায় বাল্যবিয়ে বাড়তে বাড়তে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান জানান, মহামারীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে বেড়ে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জেলার সাত উপজেলার বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে বাল্যবিয়ের এ ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যমতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ৫৭ ছাত্রী বিয়ের শিকার। যদিও স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফের দাবি ৫০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া ঘোনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩৪, তালা উপজেলার শার্শা দাখিল মাদরাসার ৪০, আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের মাড়িয়ালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২৫, কলারোয়া উপজেলার রায়টা দাখিল মাদরাসার ১৫ ও দেবহাটা উপজেলার বহেরা এটি বালিকা বিদ্যালয়ের ২৪ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এসব ছাত্রীর অধিকাংশই সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং কর্মসংস্থান সংকটের কারণে হতদরিদ্র পরিবারগুলোয় বাল্যবিয়ে বেড়েছে। এদিকে সাতক্ষীরা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্বে) এ কে এম শফিউল আযম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গত ১৬ মাসে ১৬০ অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীর বিয়ে পন্ড করা হয়েছে। এসব কিশোরীর শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী। যতসংখ্যক বাল্যবিয়ে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ঠেকানো হচ্ছে চলমান সময়ে অভিভাবকরা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বাল্যবিয়ে দিয়েছেন।

বাল্যবিয়ের কারণে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নীলফামারীর বিভিন্ন বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় জেলার ছয় উপজেলায় গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময় মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। সদর উপজেলার টুপামারী দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে গড়ে প্রায় ২৫ শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে।’ খোকশাবাড়ী এম ইউ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে অনেক দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে পরিবার মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ে দিয়েছে। আমাদের বিদ্যালয়ের ১০ থেকে ১৫ শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে।’ জলঢাকা উপজেলার রশিদপুর বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক মো. মন্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার মধ্যে না থাকায় অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। করোনার কারণে উপার্জন কমে যাওয়া দরিদ্র পরিবারগুলো অনেকটা গোপনে, কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই কিশোরীদের বিয়ে দিয়েছে।’ জেলা শিক্ষা অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নীলফামারীর ছয় উপজেলায় ৩১৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪৫০ মাদরাসা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।’ উল্লেখ্য, করোনাকালে জেলার ছয় উপজেলার ২২০ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। চাইল্ড হেল্পলাইনের প্রতিটি উপজেলায় মোবাইল টিম আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন। হেল্পলাইনটির ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে বাল্যবিয়ের যে তথ্য আসছে প্রকৃত চিত্র তার চেয়েও ভয়াবহ। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে শহরের বাসিন্দাদের অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি। আর এর প্রভাব প্রথমেই মেয়েশিশুদের ওপর পড়েছে। লক্ষ্য করে দেখেছি, গ্রামাঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেয়েশিশু বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। করোনাকালে কত শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তা এখনই বের করা না গেলেও এটি ক্রমেই স্পষ্ট হবে। তবে শুধু মেয়ে নয়, ছেলেশিশুদেরও অনুপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে। এটি স্পষ্ট যে মহামারীতে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে চার গুণ বেড়েছে। বিষয়টির গভীরতা বুঝতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বিষয়ে জরিপ চালানো প্রয়োজন।’


(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, নীলফামারী ও জয়পুরহাট প্রতিনিধি)।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর