‘দুর্নীতি করে কোনো প্রতিষ্ঠান এগোতে পারে না। বিমানে দুর্নীতির এখন আর কোনো সুযোগ নেই। এর আগে এখানে যারা দুর্নীতি করেছেন, বিভিন্ন লেয়ারে তাদের শাস্তি হয়েছে। কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি, কাউকে পদাবনতি, আবার কারও বেতন কমানো হয়েছে। আমি টিকিটিংয়ের জায়গা ও দুর্নীতির জায়গা থেকে মুক্ত হতে কাজ করছি। সবাইকে নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।’
বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. সাফিকুর রহমান এভাবেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে সব বিভাগেই কঠোরভাবে নজরদারি এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আমরা চাই বিমানের উন্নতি হোক। বাংলাদেশের উন্নয়ন হোক। আমাদের দায়িত্ব হলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা। এজন্য অবাধ তথ্য সরবরাহের বিকল্প নেই। স্বচ্ছতা এবং জবাহদিহিতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর ড. মো. সাফিকুর রহমানকে এমডি ও সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয় বিমান পরিচালনা পর্ষদ। সাফিকুর রহমান ১৯৮৬ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে ট্রেইনি কমার্শিয়াল অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক প্রশাসন ও মানবসম্পদ, পরিচালক প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস সাপোর্ট এবং পরিচালক বিপণন ও বিক্রয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ট্যারিফ, মার্কেট রিসার্চ, রিজার্ভেশন, কার্গো প্রভৃতি শাখায় সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও গ্রিস স্টেশনে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দীর্ঘ পেশাগত জীবন শেষে তিনি ২০১৭ সালে অবসরে যান। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। গত বুধবার বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিমানের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।
ড. মো. সাফিকুর রহমান বলেন, প্রায় এক বছর আগে আমি বিমানের দায়িত্ব গ্রহণ করি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিমানের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নেওয়াটাই ছিল আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ। আমি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। প্রতিটি সেক্টরে নতুন করে কাজ করেছি। যাত্রীদের অভিযোগ, অনলাইনে বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। আবার আসন ফাঁকা রেখে বিমান যাত্রী পরিবহন করে। আমি বিমানের দায়িত্ব পাওয়ার পর এ সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করি। তিনি বলেন, ডিজিটালের পূর্ণ সুবিধা ব্যবহার করে যাত্রীদের সেবা দিতে শুরু করি। এখন আসন আর ফাঁকা থাকছে না। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকেই বিমানের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। আগের মতো বিমানের টিকিট আর ব্লক করে রাখা হয় না। অনলাইনে টিকিট পেতে সব বাধা নিরসন করা হয়েছে। এতে বিমানের টিকিট না পাওয়ার অভিযোগটি আর নেই। এ কারণেই গত জানুয়ারি মাসে বিমানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ টিকিট বিক্রির নজিরও তৈরি হয়। ড. সাফিক বলেন, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯৩৭ কোটি টাকা অনিরীক্ষিত মুনাফা অর্জন করেছে বিমান। আর এই মুনাফার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছরের ইতিহাসে বিমান এক অনন্য রেকর্ড গড়েছে। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগে বিমানের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জিত হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ৪৪০ কোটি টাকা। যাত্রীদের আস্থা ও সমর্থনই এ রেকর্ড মুনাফা অর্জনে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে। বিমান অবতরণের পর প্রথম যাত্রী ১৮ মিনিটেই লাগেজ পাচ্ছেন। লাগেজ কাটা রোধে কর্মীদের জন্য ১৮০টি বডিক্যাম ক্যামেরা দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছা করলেই এই ক্যামেরা তারা বন্ধ করতে পারবে না। যে কারণে লাগেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কমেছে। সার্বিকভাবে মনিটরিং বাড়ানোর কারণে লাগেজ দ্রুত পাচ্ছেন যাত্রীরা। নতুন গন্তব্যে বিমানের ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে এমডি বলেন, আমাদের এক্সিটিং (নতুন গন্তব্য) ফ্লাইট বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। মালে, জাকার্তা, সিউল ও সিডনিতে আমরা পর্যায়ক্রমে প্রত্যাশা করছি। তার আগে এখন যা আছে যেসব আছে সেগুলো আরও স্মুথ করতে কাজ করছি। বিমানের এমডি বলেন, ১৯৭২ সালে মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা আয় দিয়ে যাত্রা করা বিমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সীমিত অবকাঠামো ও সম্পদের মধ্যে ধীরে ধীরে আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক এয়ারলাইনসে পরিণত হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ১১ হাজার ৬৩১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আয় হয়েছে কোম্পানির। তিনি বলেন, বিমানের বহরে ২১টি উড়োজাহাজ ছিল, যার মধ্যে বর্তমানে ১৯টি নিজস্ব মালিকানাধীন উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ এবং দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার। এই উড়োজাহাজ দিয়েই আন্তর্জাতিক ২২টি এবং অভ্যন্তরীণ ৭ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে এসব রুটে নিশ্চিন্তভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হলে দুটি বড় এবং ২টি ছোট উড়োজাহাজ প্রয়োজন। উড়োজাহাজ সংগ্রহ করাই এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে বিমান বহরে ৫০টি উড়োজাহাজ হলে আকাশ পরিবহনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। বিমানের ফ্লাইট ডিলে সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের অন-টাইম পারফরম্যান্স নরমালি ৭৫ পারসেন্ট। কীভাবে ডিলে কমানো যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করছি। সম্প্রতি একের পর এক প্লেনে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দেশ-বিদেশে যখন চরম ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে, শিডিউলে নেমেছে বিপর্যয়।
এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিমানের এমডি বলেন, গত এক মাসে বেশ কয়েকটি যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে মনুষ্য তৈরি কোনো কারণ রয়েছে কি না তা জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলেই বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার বলা যাবে। তবে মনিটরিং আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। আকস্মিক পরিদর্শনে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
যে কারণে হয়তো বেশ কয়েক দিন ধরে এ ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বিমানে। এ সময় বিমান কর্মীদের সোনা চোরাচালান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।
আকাশপথে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি ও লোকসানে থাকা বিমান নিয়ে প্রত্যাশা জানিয়ে মো. সাফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিমানে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। বিমানের সেবার মান বা সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি।’