দুই দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় এসেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। ১৩ বছর পর দেশটির কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। সফরের দ্বিতীয় দিন আজ সকালে প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে ছয়টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে সফরের প্রথম দিন গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইসহাক দার। এসব বৈঠকে একাত্তর ইস্যুসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ও আঞ্চলিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া আজ সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে তাঁর বাসভবন ফিরোজায় যাবেন ইসহাক দার। এ ছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন ঢাকায় সফররত পাকিস্তানি উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। আজ দুপুর আড়াইটার দিকে জামায়াত আমিরের বসুন্ধরার বাসায় দেখা করতে যাবেন তিনি। গতকাল ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন ইসহাক দার। প্রথমে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, এরপর জামায়াতে ইসলামী এবং সবশেষে বিএনপির প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইসহাক দারের বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে জানায়, ইসহাক দার পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে তাঁর দেশের অঙ্গীকারের কথা দলগুলোকে জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের বিষয়ে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্সে এক পোস্টে জানায়, জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানের মন্ত্রী বাংলাদেশে বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াত নেতাদের সাহস ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার প্রশংসা করেন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার, সাবেক হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী, বর্তমান হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের গভর্নর তারিক বাজওয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ইলিয়াস মাহমুদ নিযামী ও মুহাম্মদ উমায়ের লতিফ, পরিচালক দিলদার আলি আবরো এবং ডেপুটি চিফ অব প্রোটোকল হাফিজ উল্লাহ। বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, বৈঠকে একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়নি। এটি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় আলোচনার বিষয়। তবে আমাদের মধ্যে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সার্ককে কীভাবে আরও গতিশীল করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, একাত্তর ইস্যু সমাধানে পাকিস্তান প্রস্তুত আছে বলে আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী। এ সময় দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বৈঠকে আমরা বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আগে যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল সেখান থেকে উন্নতির সুযোগ আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ যেসব বিষয় উন্নয়ন করা যায়, সে বিষয়ে কথা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃত্বের, কোনো হেজিমনি (আধিপত্য) থাকবে না। এর আগে, গতকাল দুপুরে বিশেষ বিমানে করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সফরের দ্বিতীয় দিন আজ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মূল বৈঠকটি হবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। শুরুতে একান্তে এবং পরে প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করবেন দুই শীর্ষ কূটনীতিক। পরে বিকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ইসহাক দার। এ ছাড়া সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে তাঁর বাসভবন ফিরোজায় যাবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী। গতকাল বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ব্যবসা, বিনিয়োগ, সংযুক্তি, কৃষিসহ নানা পর্যায়ে দুই দেশের লোকজনের চলাচল সুগম করাসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় আলোচনায় থাকবে। সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়ার পাশাপাশি অমীমাংসিত তিন ঐতিহাসিক ইস্যুর সুরাহার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। এ ছাড়া বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তিসহ ছয়টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে গুরুত্ব দেবে ইসলামাবাদ। ঢাকার চাওয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এর আগে, ২০১২ সালে ডি-৮ সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খার।