লালন ভক্ত-অনুরাগী, সাধু-গুরু-গোঁসাই, বাউল-বৈষ্ণবের পদচারণে এখন মুখরিত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়ি। সাঁইজির ১৩৫তম তিরোধান উৎসবের দ্বিতীয় দিনে গতকাল একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি আর প্রেমজুড়ির তালে মাতোয়ারা ছিলেন বাউলরা। দেশবিদেশ থেকে ছুটে আসা লালনভক্ত, সাহিত্য সমালোচক ও তাত্ত্বিকরাও মাতিয়ে তোলেন বাউলধাম। শুক্রবার রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত এ সাধুর হাট ভাঙবে আজ বিকালে। এ আয়োজন ঘিরে আখড়া পরিণত হয়েছে নানান ধর্মবর্ণের মানুষের মিলনমেলায়। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, কেউ গেরুয়া বসনে। মাজারপ্রাঙ্গণে দেখা যায়, অসংখ্য সাধু-ফকির-ভক্ত সাঁইজির সমাধিতে ফুল, আতর, গোলাপ ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। চলছে গানে গানে লালনের জাতপাতহীন, মানবতাবাদী ও অহিংস দর্শনের প্রচার। ‘বাড়ির পাশে আরশীনগর’, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ এমন অসংখ্য গানে মেতে ওঠে বাউলধাম। আখড়ার আশপাশ ও কালী নদীর তীর ধরে ছোট ছোট আস্তানা গড়ে সাঁইজিকে গানে গানে স্মরণ করতে দেখা যায় বাউলদের। তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ভক্তরাও। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তোলেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। গতকাল সকালে ছিল ‘বাল্যসেবা’। এ পর্বে সকালে অনেক বাউল ‘ভেক’ গ্রহণ করেন। দুপুরে হয় ‘পূর্ণসেবা’। এ পর্বে সাদা ভাত, মাছ, সবজি ও মিষ্টান্ন খেয়ে চলে অবিরাম ধারায় গান। এ ছাড়া কালী নদীর পাড়ে গোসল সেরে পূর্ণসেবা নেন ভক্ত-সাধুরা।
বাউল আয়েশা বলেন, ‘লালনের কাছে ধর্মবর্ণ, জাতপাতের বিচার ছিল না। আশ্রয়হীন নারী-পুরুষকে তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন, নাচতেন। কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন অচিন পাখির, সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান।’ দর্শনার্থী মসলেম শেখ বলেন, ‘লালনের গানে মানবতাবোধ, অহিংসভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিনদিন তাঁর ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে। সাঁইজির আদর্শ অনুসরণ করলে এ বিশ্বে হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত।’ প্রসঙ্গত, উপমহাদেশের প্রখ্যাত মরমি সাধক ফকির লালন সাঁই বাউল গানের মাধ্যমে মানবতাবাদী দর্শন প্রচার করেছেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে ভক্ত-অনুসারীরা সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন। প্রতি বছর ১ কার্তিক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছেঁউড়িয়ায় তাঁর তিরোধান দিবস পালন করা হয়।
লালনের সুরের ঢেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে : লালনের ভাববাণী ও সুরের প্রবহমান স্রোতে ঢেউ খেলেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। নিমগ্ন চিত্তে সাঁইজির দার্শনিক ভাবনার অমূল্য বাণী হৃদয়ে ধারণ করে পিনপতন নীরবতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সেজেছিল ভিন্ন রূপে। শিল্পীদের পরিবেশনার সময় একাগ্র চিত্তে পিনপতন নীরবতায় সুরের সমুদ্রে ডুব দেওয়া। এরপর শিল্পীর পরিবেশনা শেষে নীরবতা ভেঙে মুহুর্মুহু করতালিতে শিল্পীর প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন ও সেই সঙ্গে ‘ওয়ান মোর ওয়ান মোর’ ধ্বনিতে গানের আবেদন। আল্লাহ আল্লাহ বলরে মন, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, মিলন হবে কতদিনে, খাঁচার ভেতর অচিন পাখিসহ একের পর এক পরিবেশনায় সমগ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশ মূর্ত হয়ে উঠে লালন ফকির। অগণিত ভক্তদের পদচারণে মুখরিত ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মঞ্চের শিল্পীদের সঙ্গে জনপ্রিয় গানগুলোর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান লালনভক্ত অনুরাগীরা। লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গতকাল রাতে এমন দৃশ্যকল্পই চিত্রিত ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। জাতীয় পর্যায়ে লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। লালন সাঁইয়ের ওপর নির্মিত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যায় শুরু হয় এই আয়োজন। এর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ইবনে ওয়াহাবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর-সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এদিকে লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ১৭ অক্টোবর থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়ার লালন ধামে চলছে তিন দিনের লালন উৎসব। আজ শেষ হবে এই উৎসব।