পর্ব-১
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে’- রবীন্দ্রনাথের এমন উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে হোমারের (মহাকাব্য ইলিয়াডের খণ্ড ১৪-এর ২৫৯ থেকে ২৬১ লাইনের) উচ্চারণ এক কাঠি এগিয়ে। “...যেখানে প্রেমের উত্তাপ, স্পৃহার স্পন্দিত সবেগ ধাবন, প্রেমিকের ফিসফাস, অপ্রতিরোধ্য- তা বুদ্ধিমান মানুষকে উন্মত্ত করে তুলবার এক জাদু।”
নর-নারীর চিরায়ত সম্পর্কে ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা অহরহই ঘটে। প্রেমের এমন জটিল সমীকরণ কখনো কখনো ডেকে আনে ভয়ানক পরিণতি, জন্ম দেয় ট্র্যাজেডি। তাই নাটক, সিনেমা কিংবা উপন্যাসে ‘ত্রিভুজ প্রেম’ একটি বহুল চর্চিত বিষয়। এমন কিছু ত্রিভুজ প্রেম আছে যেগুলোর প্রভাব যুগ যুগ ধরে রয়ে গেছে ইতিহাসে। হেলেন, মেনেলায়েস এবং প্যারিস-এর প্রেম সেরূপ প্রেমেরই ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক অনশ্বর নিদর্শন।
সৌন্দর্য, প্রেম আর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সাড়ে ৩ হাজার বছর পরও ইতিহাসের অন্যতম বহুচর্চিত চরিত্র হেলেন। স্পার্টার রানি হেলেন, রাজা মেনেলায়েস এবং ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের মধ্যে যে ত্রিভুজ প্রেমের সূত্রপাত হয়েছিল, তা শুধু কালজয়ী বীরদেরই মৃত্যুর কারণ হয়নি, ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ঐশ্বর্যমণ্ডিত পুরো ট্রয় নগরীও। নির্মম পতন ঘটেছে পুরো সাম্রাজ্যের। মহাকবি হোমারের অমর মহাকাব্য ‘দ্য ইলিয়াড’ সেই যুদ্ধকাহিনি চিত্রিত করেছে পরম মাহাত্ম্য ও শিল্পিত মুনশিয়ানায়।
হেলেন প্রসঙ্গের পূর্বলেখ হিসেবে ‘ইলিয়াড’সহ আরও কিছু মহাকাব্যের ওপর খানিকটা আলোকপাত করা যাক। ‘ইলিয়াড’ সর্বমোট ২৪ সর্গে বিভক্ত ১৬,০০০ পঙ্ক্তির গ্রিক মহাকাব্য। আধুনিক গ্রহণযোগ্য সংস্করণে ইলিয়াডে রয়েছে ১৫,৬৯৩টি ছত্র। হোমারের অপর মহাকাব্য ‘ওডিসি’ ১২,১১০ লাইনের এবং দান্তের ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’ ১৪,২৩৩ লাইনের। আরেক অন্ধ মহাকবি মিলটনের মহাকাব্য চধৎধফরংব খড়ংঃ-এর পঙ্ক্তির সংখা ১০ হাজারেরও বেশি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কাব্যের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। এতে মোট পঙ্ক্তি সংখ্যা ৭৫০। আর এডমান্ড স্পেনসারের ‘দ্য ফেইরি কুইন’ মহাকাব্যের মোট অনুচ্ছেদ সংখ্যা ৪, ০০০, আর পঙ্ক্তি সংখ্যা ৩৬,০০০। মহাভারত এখন পর্যন্ত রচিত পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাকাব্যগুলোর মধ্যে একটি। এটিতে ২ লাখেরও বেশি শ্লোক লাইনে ১৮ লাখ শব্দের সমাহার ঘটেছে, যা লিখতে ৬০০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
ঊঢ়রপ (মহাকাব্য) শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘বঢ়ড়ং’ থেকে- যার অর্থ শব্দ, আখ্যান বা সংগীত। প্রাচীন গ্রিসের ইলিওন শহরের নামানুসারে আমাদের আলোচ্য এই মহাকাব্যের নামকরণ করা হয় ‘ইলিয়াড’। অন্ধ মহাকবি হোমার এই মহাকাব্যের রচয়িতা। ‘হোমার’ গ্রিক শব্দ। যার দুটো অর্থ হতে পারে- অন্ধ ও জিম্মি। এ থেকে ধারণা করা হয়, হোমার একজন গ্রিক ক্রীতদাস ছিলেন, যিনি আবার অন্ধও ছিলেন। হোমারের অন্ধত্ব নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্য একটি হচ্ছে কোনো এক শাস্তিস্বরূপ নাকি হোমারের চোখ উপড়ে ফেলা হয়। তবে হোমার ঠিক কীভাবে অন্ধ হয়েছেন, তা নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারেনি ইতিহাসবিদরা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে/অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।”---মহাকবি মিল্টন এবং হোমারের বেলায়ও ঘটেছে তেমনটাই।
বাস্তব জীবনে অন্ধ হয়ে থাকলেও আত্মিকভাবে অন্ধ ছিলেন না হোমার। অন্তর দিয়ে চারপাশ অনুভব করতেন। অন্ধ জগতেই তিনি ট্রয়ের ময়দানে দেবতা আর মানুষদের লড়াই দেখতে পেয়েছেন। তার দুই মহাকাব্যে তা সুদৃঢ়ভাবে ফুটেও উঠেছে দীপ্যমান হয়ে। ইলিয়াড ও ওডিসি ছাড়াও হোমারের আরো ২৩ টি কাব্য রয়েছে।
ইলিয়াড মহাকাব্যের বিষয় ট্রয়ের যুদ্ধ। এর লিখিত রূপ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর বলে ধারণা করা হয়। যুদ্ধ ঘটেছে তাম্র যুগে- গ্রিসের ট্রয় এবং মাইসেনিয়ার মধ্যে। ট্রয়ের যুদ্ধের গল্পটি কিংবদন্তি এবং কিছু ঐতিহাসিক নির্ভুলতার মিশ্রণ। যুদ্ধটি খ্রিস্টপূর্ব ১,১৮০ অব্দে দিকে ঘটতে পারে, যা হোমারের গল্পে ঘটেছে। যুদ্ধ সংঘটিত হয় এক নারীকে কেন্দ্র করে, যার নাম হেলেন। যুদ্ধে গ্রিকদের সেরা বীর ছিল এ্যাকিলিস আর ট্রয়ের পক্ষে ছিল মহাবীর হেক্টর। মোট ৪৬ জন অধিনায়কের অধীনে ২৯টি কন্টিনজেন্টে ১,১৮৬টি জাহাজে, প্রতি জাহাজে ১২০ জন করে সর্বমোট পুরো ১ লাখ ৪২ হাজার ৩২০ জন পুরুষ যুদ্ধে নিয়োজিত হয়। ট্রয়ের যুদ্ধ শুরু খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০ শতকে এবং শেষ হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১২৪০ শতকে। যুদ্ধে ১৮৮ জন ট্রোজান এবং ৫২ জন গ্রিকসহ সর্বমোট ২৮৮ জন মারা যায়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের মূল উপজীব্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ স্থায়ী হয় মাত্র ১৮ দিন। সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাণ্ডবপক্ষে অংশ নেওয়া ১৫,৩০,৯০০ সেনার মধ্যে আটজন, আর কৌরবপক্ষে ২৪,০৫,৭০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩ জন যোদ্ধা বেঁচে ছিলেন। উভয় পক্ষের সর্বমোট ৩৯,৩৬,৫৮৯ জন যোদ্ধা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
১০ বছরব্যাপী চলমান ট্রয়যুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন হেক্টর এ্যাকিলিস কর্তৃক নিহত হন এবং এর মাধ্যমে মূলত ট্রয়বাসীর পরাজয় নিশ্চিত হয়। যুদ্ধ শেষে গ্রিক সেনারা সুরক্ষিত ও ঐশ্বর্যে সাজানো নগরী ট্রয় জ্বালিয়ে খাক করে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
ট্রয় আধুনিক তুরস্কের একটি প্রাচীন শহর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, তবে এটি হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’-তে কিংবদন্তি ট্রোজান যুদ্ধের জন্যও বিখ্যাত। কিংবদন্তি আছে যে, ট্রয় শহরটি ১০ বছর ধরে অবরুদ্ধ ছিল এবং শেষ পর্যন্ত রাজা আগামেমননের নেতৃত্বে একটি গ্রিক সেনাদল দ্বারা এর পতন ঘটে। ১৯৬৮ সালে ট্রয় নগরী খনন চলাকালে প্রমাণিত হয়, সেখানে একের পর এক বেশ কয়েকটি শহর নির্মিত হয়েছিল। ‘হেলেন অব ট্রয়’ ছিল সেই ভুবনমোহিনী নারী, যার প্রেমের আগুনে পুড়ে ভস্ম হয় তাবৎ সাম্রাজ্য।
আজও তুর্কিদের বিশ্বাস, এ রাজ্য থেকে বিনা অনুমতিতে কেউ কিছু নিতে চাইলে যুদ্ধ অনিবার্য, হোক তা মাটি কিংবা মানবী। বারবার ধ্বংসের পরও ইতিহাসে যে নগরী চির অম্লান, যাকে পুড়ে ছাই হতে হয়েছে এক রমণীর প্রেমের পরিণতিতে। যে রমণীকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে সহস্র বছরের ইতিহাস। গ্রিক ও রোমান পুরাণের সর্বাধিক আলোচিত নারী চরিত্র তিনি। সেই হেলেন আর ট্রয়কে নিয়েই আজকের এই পর্ব। ‘হেলেন’ কে দিয়েই শুরু করা যাক আলোচনার মূল উপজীব্য।
“এই কি সেই মুখশ্রী যার জন্য সাগরে ভেসেছে সহস্র জাহাজ/ আর পুড়ে ভস্ম হয়েছে ইলিয়াম (ট্রয়)-এর অত্যুচ্চ দুর্গ/ মায়াময়ী হেলেন, আমাকে অমর করে তোলো তোমার একটি নিবিড় চুম্বনে...।” এগুলো মার্লো’র নাটক ‘ দ্য ট্র্যাজিকাল হিস্ট্রি অব ডক্টর ফস্টাস’ থেকে নেওয়া পঙ্ক্তি। শয়তান মেফিস্টোফিলিসের সহায়তায় ফস্টাস জাদুশক্তিবলে হেলেনের অনিন্দ্য মোহনীয় রূপ দর্শন করে এমন উক্তি করেন।
আগ্রহী পাঠকদের মনে নিশ্চয়ই এখন ভেসে উঠছে রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কবিতার পঙ্ক্তি : “শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী--/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ/সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।/সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা/ অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।/ কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,/ সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,/ বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,/ চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।/ লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,/ তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।/ পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা--/ অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।”
হেলেনও ছিল তেমনি- অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক দেবী। সাধারণভাবে হেলেন নামে পরিচিত হলেও তাকে বলা হয় ‘হেলেন অব ট্রয়’। কেউবা আবার বলেন ‘হেলেন অব স্পার্টা’। হেলেনের বুৎপত্তিগত অর্থ করলে দাঁড়ায় “আলোকবর্তিকা”। অন্য মতে, হেলেন শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘টর্চ’ থেকে। গ্রিক ভাষায় হেলেন শব্দের অর্থ হলো ‘জ্বলন্ত সামগ্রী’। এমনো জানা যায়, দেবী আফ্রোদিতিই হেলেন নাম নিয়ে মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন, তারপর আশ্রয় নিয়েছিলেন স্পার্টার রাজা টিন্ডারাসের প্রাসাদে। জন্মবৃত্তান্তে মতভেদ থাকলেও খ্রিস্টপূর্ব ১২১৪ সালে স্পার্টার রাজা টিনডারাস এবং তার স্ত্রী লিডার ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। রাজ জ্যোতিষী সেই শিশুর নাম রাখেন হেলেন, সঙ্গে এই বলে আশীর্বাদ করেন যে, নামের কারণেই জগদ্বিখ্যাত হবে এই কন্যা।
মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়ডি ওওডিসি’, ইউরিপিডিসের ‘হেলেন’, আর গ্রিক মাইথোলজির বর্ণনা অনুযায়ী টিনডারাস বাহ্যত হেলেনের জনক হলেও প্রকৃত জনক দেবতাধিরাজ জিউস। পুরাণ মতে, কোনো একদিন জিউস রাজহংসের বেশে ছিলেন। তখন একটি ঈগল তাকে তাড়া করলে জিউস আশ্রয় প্রার্থনা করেন রানি লিডার কাছে। রানি লিডার রূপে মুগ্ধ রাজহংসরূপী জিউস লিডার উষ্ণ সান্নিধ্যে আসেন এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ফলশ্রুতিতে লিডা প্রসব করে একটি ডিম। সেখান থেকে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে হেলেন। কারও কারও মতে, লিডা নয়, বরং প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কন্যা ছিলেন হেলেন। রাজহংসের সঙ্গে মিলনে অখুশি নেমেসিসের ফেলে দেওয়া ডিমটি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন রানি লিডা। আর তা ফুটেই জন্ম হয় হেলেনের। ভ্যাটিকানের পুরাণ বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজহংস ও লিডার সঙ্গমে দুটো ডিম প্রসূত হয়। একটি জন্ম দেয় দুই বোন ক্লাইটেমেনেস্ত্রা এবং হেলেন; অন্যটি দুই ভাই; ক্যাস্টর এবং পুলাক্স। অনেকে মনে করেন, এক ডিম থেকে বের হয়েছে তিনজন- দুই ভাই এবং বোন হেলেন।
সময় পরিক্রমায় ধীরে ধীরে স্বর্গীয় রূপ-লাবণ্য আর অসাধারণ মোহনীয় নারীত্বের পূর্ণতা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন অপরূপনন্দিনী ‘হেলেন অব ট্রয়’।
সে সময় হেলেনের রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ গ্রিসের হাজারো যুবক পাণিপ্রার্থী হতে থাকে হেলেনের। তাদের মাঝে মেনেলায়েস আবির্ভূত হন সৌভাগ্যবান হিসেবে। হেলেনের অমতেই বিয়ে দেওয়া হয় মেনেলায়েসের সঙ্গে। প্রাচীন গ্রিস সে-সময় বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
[চলবে]