পাকিস্তানের জনপ্রিয় 'ডন' পত্রিকার অনলাইনে এক ক্রিকেটভক্তের মন্তব্য, 'সেরা দলই জয় পায়। পাকিস্তান যা করছে, তা কী খেলার মধ্যে পড়ে? এটা ঠিক সেরা ফর্ম কখনো চিরস্থায়ী নয়। হয়তো পাকিস্তানও ফর্মে ফিরবে। এই বাংলাদেশকে দেখে মনে হচ্ছে, এক নতুন শ্রীলঙ্কা! পাকিস্তানকে শেষ করে দিয়ে এখন তারা ভারতের দিকে তাকিয়ে। জয়ের কৃতিত্ব বাংলাদেশকে দিতেই হবে। অসাধারণ খেলেছে টাইগাররা।'
শুধু এই পাকিস্তান ক্রিকেটভক্তই নন, গোটা ক্রিকেটবিশ্ব এখন মাশরাফিদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে আর কখনো এমন ঘটনা ঘটেছে, বলে-কয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারান! এর আগে বাংলাদেশ কেবল একবারই বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছিল, ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে জয় নিয়েও প্রশ্ন ছিল! কেননা, ওই সময় উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে গেইল, সারওয়ান, চন্দরপলসহ সেরা ক্রিকেটাররা খেলেননি।
তবে এই দলটি যে পাকিস্তানের সেরা দল নয়, তা কিন্তু বলা যায় না! কেননা আফ্রিদি-মিসবাহ তো আর সারা জীবন খেলবেন না। তাছাড়া ইনজুরির ওপরও তো কারো হাত নেই। হয়তো তরুণ ক্রিকেটার বেশি, কিন্তু এটাই এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সেরা দল। এর বিকল্প নেই। সেরা পাকিস্তানকে হারিয়েই সিরিজ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ।
সিরিজ শুরুর আগে সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন বাংলাদেশকে 'ফেবারিট' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, এটা হাস্যকর কথা! বিশ্বকাপে ভালো করেছে বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতবে? অবিশ্বাস করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কেননা, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপেও তো ভারতকে হারিয়ে শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছিল টাইগাররা। সেবার সুপার-এইটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও জিতেছিল বাংলাদেশ। তারপর কি হয়েছে? পরের সিরিজ থেকে সেই আগের দল! কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে যে সত্যি সত্যি বাংলাদেশ দল আমূল বদলে গেছে তা বোঝা গেল পাকিস্তান সিরিজেই। এ সম্পর্কে অধিনায়ক মাশরাফি বলেন, 'এই সিরিজ জেতাটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবাই বলছিল আমরা ফেবারিট। ভালোভাবে জিততে পারায় ভালো লাগছে।'
দুই ম্যাচে জয়ের ব্যবধান দেখুন! প্রথম ম্যাচে ৭৯ রানে, দ্বিতীয়টিতে ৭ উইকেটে জয়। দুই ম্যাচে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি ম্যাচে পাকিস্তান প্রভাব বিস্তার করেছে। কী বোলিং, কী ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিং -সব বিভাগেই অসাধারণ টাইগাররা। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথাই চিন্তা করুণ! দলে এখন ক্রিকেটারদের মধ্যে যেন রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে, কে কার চেয়ে ভালো করবে। এখন কোনো ক্রিকেটারের মধ্যে সেই পুরোনো মনোভাব নেই, পরের ম্যাচ নিশ্চিত হওয়ার মতো স্কোর হয়ে গেলেই দায়িত্ব শেষ! পুরো দল ইতিবাচক এক ফ্রেমে!
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো করলেও ওপেনিংয়ে সমস্যা ছিল। কিন্তু এই সিরিজে ড্যাসিং ওপেনার তামিম ইকবাল টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সুখের বিষয় হচ্ছে, সাকিব আল হাসানের মতো ব্যাটসম্যানও ভালোভাবে সুযোগ পাচ্ছেন না ব্যাটিংয়ে। বোলিংয়ে এর আগে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ ছিল স্পিননির্ভর এক দল। আর এখন স্পিন-পেসের কী দুর্দান্ত ভারসাম্য! এই দলে দুই দুইজন পেসার আছেন, যারা নিয়মিত ১৪০ কিমি গতিতে বল করেন। সেই সঙ্গে মাশরাফির অধিনায়কত্বে বৈচিত্রতা তো আছেই!
শুধু ডনের ওই পাঠক নন, এখন এই বাংলাদেশকে সবাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই তুলনা করছে! ৯৬-র আগে শ্রীলঙ্কাও তো পাত্তাই পেত না। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর একই পথে যেন বাংলাদেশও! কেননা 'মিরাকল' ঘটিয়ে নির্দিষ্ট ম্যাচ জেতা যায়। একটি সিরিজও না হয় ভালো করা গেল, কিন্তু পরের সিরিজে ঠিকই আসল চেহেরা বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের পরের সিরিজে আরও বেশি আত্দবিশ্বাসী। জয়ের জন্য আরও বেশি ক্ষুধার্ত। যে কারণে পাকিস্তানের মতো দলের বিরুদ্ধে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
শুধু মাঠের ক্রিকেটে নয়, শরীরী ভাষার জন্যও প্রশংসা পেতে পারেন মাশরাফিরা। সবার মধ্যে সে কী আত্দবিশ্বাস! আগে যেমন শরীরী ভাষার কারণে বাংলাদেশ হারার আগেই একবার হেরে যেত, এখন ঠিক উল্টো। বিজয়ের আগে আরেক জয়! এখন উদযাপনেও টাইগারদের পেশাদারিত্ব! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৬ বছর পর জয়, মাঠে কোনো উদযাপন নেই। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে বিধ্বস্ত করে সিরিজ জয় উদযাপন নেই। শরীরী ভাষা দেখে মনে হয়েছে, যেন আরব আমিরাত কিংবা কেনিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জিতেছে। তবে মাশরাফি বলেছেন, 'জয়োৎসব করা জরুরি। তাহলেই কেবল জয় কাছে আসে।'
টাইগারদের এই আচরণ দেখে অন্তত এটা নিশ্চিত হওয়া যায়, তারা এখনো ভীষণ ক্ষুধার্ত! শেষ ম্যাচেও পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়ার বাসনা মনে! মাশরাফি হয়তো তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটা ৩-০ হওয়ার পরই মাঠে সেলিব্রেশনে মেতে উঠবেন। দেশের ১৬ কোটি মানুষও তো সেটাই দেখতে চায়! দেশের মাটিতে আরেকটি 'বাংলাওয়াশ', মন্দ কিসের!