মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মোটরসাইকেলে ঝুঁকির যাত্রা

♦ হাইওয়েতে বেপরোয়া চলাচল দুর্ঘটনার বড় কারণ ♦ টিনএজার বাইকারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

শামীম আহমেদ

মোটরসাইকেলে ঝুঁকির যাত্রা

 ছবি : রোহেত রাজীব

ঘটনা-১ : পাবনা শহর থেকে একটি মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন তিন শিক্ষার্থী। কিছু দূর চালানোর পর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি কিশোর চালক। সড়ক ছেড়ে ঢুকে যান পার্শ্ববর্তী স’মিলে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যু হয় দুজনের। বাকিজন গুরুতর আহত হন। গত ১০ জানুয়ারি ভোরে পাবনা-সাঁথিয়া সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

ঘটনা-২ : দিনাজপুরে বাবার মোটরসাইকেলে চড়ে দুর্গাপূজা দেখতে যাচ্ছিল ছয় বছরের শিশু আরাধনা রায়। কিন্তু বাবাকে শক্ত করে ধরে বসার মতো শক্তি ছিল না ছোট্ট হাত দুটিতে। ব্রেক কষতেই মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে মেয়েটি। হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি শিশুটিকে।

ঘটনা : ৩ পটুয়াখালীর গলাচিপার চরআগস্তি এলাকা থেকে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে চড়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন গৃহবধূ রাবেয়া বেগম। মাথায় ছিল না হেলমেট। কাজীরহাট এলাকায় বাইকটির চাকা ভাঙা সড়কের গর্তে পড়তেই এক পাশে দুই পা দিয়ে বসা রাবেয়া ছিটকে পড়েন। মারা যান হাসপাতালে।

ঘটনাগুলো পুরনো হলেও প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। মানসম্মত হেলমেট না পরা, উচ্চগতিতে বাইক চালনা, অনেক বাইকারের মধ্যে সবাইকে পেছনে ফেলার মানসিকতার কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। বাইকার নিজেও ঝুঁকিতে পড়ছেন, অন্যদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন। অনেক সময় অন্য যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি হচ্ছে বাইকারদেরই। প্রতি বছর ঈদযাত্রায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল হয় সবচেয়ে দীর্ঘ। এর মধ্যে বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু থাকে সর্বাধিক। ঢাকার গণমাধ্যম কর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে মোট এক হাজার ৩০২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১ হাজার ৪৮৪ জন নিহত ও ২ হাজার ৪৮৫ জন আহত হন। এর মধ্যে ৫২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫৭৯ জন; যা মোট দুর্ঘটনা ও নিহতের যথাক্রমে ৪০ দশমিক ৪৭ ও ৩৯ দশমিক ০১ শতাংশ। দুই চাকার এ ক্ষুদ্র বাহনে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ছয়জনেরও বেশি মানুষ। গত রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি আগামী ঈদে সব মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে।

এদিকে দুর্ঘটনা কমাতে এবারও ঈদুল ফিতরে পদ্মা সেতুতে চলছে না মোটরসাইকেল। তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকছে না বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত রবিবার জানিয়েছেন।

যানজট এড়িয়ে সহজে গন্তব্যে পৌঁছানোর বাহন হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে মোটরসাইকেল। অনেকের আয়ের পথও খুলে দিয়েছে দ্বিচক্রযানটি। মানুষের জীবনে এনেছে স্বাচ্ছন্দ্য। ফলে গ্রাম থেকে নগর- সর্বত্র বাড়ছে মোটরসাইকেল। ২০২২ সালে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন নিবন্ধন হয়েছে মোট ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। আর শুধু ঢাকাতে মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮টি। এর আগে ঢাকায় সর্বোচ্চ মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছিল ২০১৮ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৫১টি। কিন্তু মোটরসাইকেল মানুষের জীবনে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে; তেমনি বাড়িয়েছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা। বাইকারদের অন্যতম সংগঠন বাইকবিডি ডটকমের প্রধান নির্বাহী শুভ্র সেন বলেন, বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শঙ্কা অন্য দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি। তবে নিয়ম মেনে চালালে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা দুটোই কমানো সম্ভব। অনেকেই নিজের দক্ষতা বিবেচনা না করে বেশি গতিতে বাইক চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলার সময় একটা ছোট পাথরও বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাইকের গতি বাড়ানো উচিত সড়কের অবস্থা ও নিজের দক্ষতা বিবেচনা করে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অধিকাংশ মৃত্যুই হয় মাথায় আঘাতের কারণে। এ জন্য সঠিক মাপের ভালো হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। বাইকে একপাশে দুই পা দিয়ে বসায়ও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ড্রাইভিংয়ের সময় কোনো চিন্তা করা, মোবাইলে কথা বলা বা হেডফোন ব্যবহার করা উচিত নয়। বাইকে শিশু বহন ব্যক্তিগতভাবে আমি সঠিক মনে করি না।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি। এ ছাড়া একটি বাসের বিকল্প হিসেবে সড়কে নামছে ১৫ থেকে ২০টি ছোট যানবাহন। এতে যানজট, দুর্ঘটনা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ বাড়ছে। জ্বালানি বেশি পুড়ছে। বিশ্বে যারাই মানসম্মত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করেছে, তারাই পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সফল। আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। ছোট যানবাহনে সড়ক ভরে যাচ্ছে। এর সাইডঅ্যাফেক্ট অনেক।

এদিকে রাজধানীর বাইকারদের অভিযোগ, মূল সড়কে বাসগুলো যত্রতত্র যাত্রী তুলতে হুটহাট লেন পরিবর্তন ও স্টপেজে দুই বাসের প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া প্রতিটি গলিতে অসংখ্য ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল ও খাড়া রংহীন স্পিডব্রেকারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের মতে, রাজধানীর সড়কে একটি রিকশার জায়গায় দুটি বাইক চারজন যাত্রী বহন করতে পারে। একটি প্রাইভেট কারের জায়গায় অন্তত চারটি মোটরসাইকেল আটজন যাত্রী বহন করতে পারে। চালকরা সচেতন হলে ও নিরাপত্তা নীতিমালা রাজধানীতে মোটরসাইকেল হতে পারে যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

সর্বশেষ খবর