রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেটে অবস্থিত নগরবাসীর স্বস্তির জায়গা আনোয়ারা উদ্যানও হারিয়ে গেছে। এ পার্কটি ছিল এলাকার মানুষের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। একসময় প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছোট্ট উদ্যানটিতে হাঁটাচলা করত, শিশুরা খেলত, কম আয়ের মানুষ ক্লান্তি দূর করতে জিরিয়ে নিত। কিন্তু মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণ এবং অবকাঠামো রাখায় বন্ধ হয়ে গেছে গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতিবিজড়িত পার্কটি।
আনোয়ারা পার্ক এখন মেট্রোরেলের দখলে। পুরো উদ্যানটি এখন গাছপালা শূন্য বিরানভূমি। মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রয়োজনে সাময়িক ব্যবহারের জন্য নেওয়া হলেও আনোয়ারা উদ্যানে এবার স্থায়ী স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করতে চায় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। তবে উদ্যানটি দখলের পর থেকে ক্ষোভ জানিয়ে আসছেন এলাকাবাসী। বিভিন্ন সময় মানববন্ধনও হয়েছে উদ্যানটি ফিরে পেতে। যদিও উদ্যানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের ব্যাপারে জোর আপত্তি জানিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। তখন তিনি বলেছেন, ফার্মগেটের মতো এ রকম বাণিজ্যিক এলাকায় একটা খোলা উদ্যান থাকবে না, এটা তো মেনে নেওয়া কষ্টকর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আনোয়ারা পার্কের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে নেমেছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প। আর পুরো পার্কটির একটি অংশে গড়ে তোলা হয়েছে দোতালা ভবনে মেট্রোরেলের অফিস। এক পাশে থাকা খালি জায়গায় রাখা ছিল নির্মাণসামগ্রী। এখন নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে ফেলেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। তবে দুটি ভেকু দিয়ে গর্ত করতে দেখা গেছে। মাঠের চারপাশে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে।
মাঠ প্রসঙ্গে কথা হয় ফার্মগেটের তেজতুরী এলাকার বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আনোয়ারা উদ্যানে শত শত গাছগাছালি ছিল। এখন সব বিলীন। একসময় পার্কে বসে বিশ্রাম, আড্ডা সব হয়েছে। সকালবেলা বন্ধুরা এসে ব্যায়াম করতাম। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর পার্কটি দখল হয়ে যায়। এরপর শুনছি কাজ শেষ হলে আবার পার্কটি আগের অবস্থায় ফিরবে। সিটি করপোরেশনের দেওয়া সাইনবোর্ডও আছে। কিন্তু এখানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণ হলে এ পার্ক চিরতরে হারিয়ে যাবে। তবে এ এলাকায় পার্কটা খুবই দরকার।
ফার্মগেটে পার্কের এ জায়গাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের। এটা রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব পায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে জায়গাটি মেট্রোরেলের প্রকল্প অফিস ও নির্মাণ উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহার করে আসছে ডিএমটিসিএল। যদিও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে মাঠে প্লাজা তৈরি করে জায়গাটি নিজেদের করে নিতে চাইছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানায়, মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলেও পার্কটি ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়নি। বুঝিয়ে দেওয়ার পর পার্কটি নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আবদুল বাকী মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আনোয়ারা পার্কের একটি অংশে মেট্রোরেলের অফিস রয়েছে। অন্য অংশে বিভিন্ন সরঞ্জাম ছিল। এখন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এখানে পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। কোনো প্লাজা বা মার্কেট নির্মাণ হবে না।
এ বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যেহেতু এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ থেকে প্লাজা বানানোর অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি এসেছে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে প্লাজা নির্মাণের জন্য পার্কের জায়গাটি দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, সব দেশেই মেট্রোরেলকে বিশেষ সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও মাঠটি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার কথা চলছে। উত্তর সিটি করপোরেশন থেকেও ফার্মগেটের এ জায়গাটি চাওয়া হয়েছিল। তবে যেহেতু এটা গণপূর্তের সম্পদ, তাই সিটি করপোরেশন কেবল এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করতে পারবে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৯-এর ২৫ জানুয়ারি গণ অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন ঢাকার নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাসায় চার মাসের শিশুসন্তান নার্গিসকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। এমন সময় পাকিস্তানি স্বৈরাচার সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেট টিনের বেড়া ভেদ করে আনোয়ারা বেগমের গায়ে বিদ্ধ হয় এবং তিনি নিহত হন। এ ঘটনায় তার স্মরণে মাঠটিতে আনোয়ারা বাগান নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এটা আনোয়ারা মাঠ নামে পরিচিতি পায়।