ডুবে যায় বাড়ি-ঘর। প্লাবিত হয় এলাকার পর এলাকা। কোলে-ভেলায় চড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ। বিপাকে পড়তে হয় শিশু-মহিলা-বৃদ্ধদের। পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে পশু-প্রাণী। সবার প্রাণপণ চেষ্টা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার। চরম বিপর্যয় ঘটে মানবতার। চট্টগ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এমন চিত্র তৈরি হয়। কিন্তু বন্যাকবলিত এলাকায় পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
২০২২ সালে সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ‘সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও চট্টগ্রামসহ ৩১ জেলায় ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ (আরটিআই), বজ্রপাত, সর্পদংশন, পানিতে ডোবা, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, আঘাতপ্রাপ্ত ও অন্যান্য কারণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হয় ১০ হাজারের বেশি মানুষ।’ এবারও চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ প্রায় ১২টি জেলায় বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। জটিল রোগে আক্রান্ত এবং শিশুরা নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখির শঙ্কা আছে। সংকট সৃষ্টি হতে পারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যাকবলিত এলাকায় আঘাতজনিত রোগ, শ্বাসকষ্ট, পানিবাহিত ডায়রিয়া-কলেরা-জন্ডিস-টাইফয়েড রোগ, জ্বর-সর্দি, রক্ত আমাশয়, প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিস, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ, চোখের অসুখ, গ্যাস্ট্রিক, সাপের দংশন, পশুপ্রাণী মরে পরিবেশ নষ্ট, বিভিন্ন রাসায়নিক পানিতে মিশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করা, পুষ্টির অভাব, বন্যা-পরবর্তী ১০ দিনে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার কারণে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, দুর্গত এলাকার মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া, বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ওষুধ সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চর্ম রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রফিকুল মওলা বলেন, বন্যার কারণে পানিতে পশুপ্রাণী মরে যায়। ফলে পানি দূষিত হয়। দূষিত পানির কারণে হাত-পায়ে নানা ধরনের চর্ম রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর মধ্যে স্ক্যাবিস রোগটা বেশি হয়। তাছাড়া, পানিতে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া মেশার কারণে নানা রোগ দেখা দেবে। তাই এখন থেকেই বন্যাপরবর্তী সময়ের জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। বিআইটিআইডির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশিদ বলেন, সাধারণ বন্যার সময় স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ায় ব্যাপক সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে পানিবাহিত- কলেরা, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস ও টাইফয়েড রোগ বেশি হয়। কার্যত সুপেয় পানির অভাব এবং পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণেই পানিবাহিত রোগ বেশি হয়। পানি দূষিত হওয়ায় এ সমস্যা প্রকট হয়। তাছাড়া, ঠান্ডার কারণে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুর্ঘটনাজনিত কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। সঙ্গে থাকে বিষাক্ত প্রাণীর কামড়ের ভয়। দেখা দেয় পুষ্টির অভাব। বিশেষ ডায়াবেটিস, প্রেসার, হৃদরোগসহ জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা যথাসময়ে ওষুধ খেতে না পারায় তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মুসলিম উদ্দিন সবুজ বলেন, বন্যাপরবর্তী সময়ে বড়দের চেয়ে শিশুরা বেশি সমস্যায় পড়ে। পানিবাহিত রোগ, চর্মরোগ, পুষ্টিহীনতা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে বন্যাকবলিত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্র বন্ধ থাকায় নিয়মিত টিকা কর্মসূচির বিঘ্ন ঘটবে। ফলে ডিপথেরিয়া, নিউমোনিয়া, টিবি, হোপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার ও হাম-রোবেলা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন্যার পর রোগগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি আসে পশুপাখি থেকে। বাড়ির পোষা বিড়াল ও কুকুরও রোগ ছড়াতে পারে। ইঁদুর-গবাদিপশুর মূত্র থেকে লেপটোস্পাইরোসিস এবং বিড়ালের পায়খানা থেকে টক্সোপ্লাজমোসিস হয়, যা গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ঘটায়। কুকুর ও ইঁদুরের কামড়ে জলাতঙ্ক হতে পারে। পানি ও কাদার সংস্পর্শে হাত-পায়ের চামড়ায় চুলকানি ও ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দেয়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে কীটপতঙ্গের আধিক্য দেখা যায়। ফলে এসব কীটপতঙ্গ দ্বারা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া ও ডায়রিয়া হতে পারে।