রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন নগরীর সৌন্দর্য বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও অসহায় ছিলেন দুই ঠিকাদারের কাছে। নগরীর আলোকায়নে ‘হ্যারো’ আর উন্নয়ন কাজে ‘রিথিন’-এই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তিনি সব কাজ করিয়েছেন। উন্নয়নের নামে সরকারি বরাদ্দের বড় অংশ এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে লিটনের পকেটে ঢুকেছে, অভিযোগ কাউন্সিলরদের। ২০১৯ সালের শেষের দিকে রাজশাহী মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি মোড়ে হাইমাস্ট পোল ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হয়। ফ্লাডলাইট স্থাপন এবং সহায়ক উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়া ২ কোটি টাকা হলেও রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করে। অর্থাৎ ঠিকাদারকে বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩ টাকার বেশি বিল পরিশোধ করা হয়।
এ জন্য আগেই আশরাফুল হুদা টিটোর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটির হিসাবমতো দরপত্র আহ্বান করা হয়। জানা গেছে, চীনের তৈরি ২০ থেকে ২৫ মিটার উচ্চতার একটি হাইমাস্ট পোল বা খুঁটির সর্বোচ্চ দাম ৩ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা হয়। এর সঙ্গে ৬১ শতাংশ হিসাবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ টাকা আমদানি শুল্ক, ক্রয়মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ হিসাবে ৪৩ হাজার ২০০ টাকা ভ্যাট ও আয়কর, বন্দর থেকে দেশের যে কোনো স্থানে সর্বোচ্চ পরিবহন ও স্থাপন ব্যয় ৭০ হাজার টাকা এবং প্রচলিত নিয়মে ১৫ শতাংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করলে একেকটি ফ্লাডলাইট পোলের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি খুঁটির জন্য হ্যারোকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেছে। প্রতিটি খুঁটিতে অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা করে। ফ্লাডলাইট পোলে ব্যবহৃত ২০০ ওয়াট ক্ষমতার ৩২০টি এলইডি লাইটের প্রতিটির বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা হলেও দরপত্রে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা দর ধরা হয়। সে হিসাবে মোট ২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়। ২০০ ওয়াটের প্রতিটি এলইডির দাম ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা করে মোট ২ কোটি ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। অথচ বাজারমূল্যে ৩২০টি এলইডির মোট দাম পড়ে ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬০ টাকা। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪০ টাকা পরিশোধ করা হয়। ফ্লাডলাইটে সংযোজিত ২০০টি ২৫০ ওয়াট ক্ষমতার এলইডির প্রতিটির বাজারমূল্য ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা হলেও দরপত্রে প্রতিটির মূল্য ৭৫ হাজার টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। চীনা আরওএইচএস কোম্পানির তৈরি ২০০টি এলইডির মোট বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৮০৪ টাকা। কিন্তু হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে অতিরিক্ত ১ কোটি ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকাসহ এ খাতে মোট বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। একইভাবে ১ হাজার ২৪০ মিটার ক্যাবল সরবরাহেও ঠিকাদারকে ৩৭ হাজার ২০০ টাকা বেশি বিল দিয়েছে রাসিক। ওই সময় এ ঘটনা জানাজানি হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে একটি টিম নগর ভবনে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জব্দ করে। এদিকে, নগরীর বিলশিমলা থেকে কাশিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়কবাতি বসানোর কাজটি পায় হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং।
৫ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে চার লেন সড়কটির আইল্যান্ডে চীন থেকে আনা সড়কবাতির ১৭৪টি খুঁটি স্থাপন করা হয়। তবে উদ্বোধনের কিছুদিন পর ওই বছরের এপ্রিলে ধূলিঝড়ে ৮৬টি খুঁটি উপড়ে পড়ে। হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এ প্রকল্পেও সাবেক মেয়র লিটন মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। একাধিক কাউন্সিলর জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের তৎকালীন প্রকৌশলী গোলাম মুর্শেদ এ কাজে মেয়র লিটনকে সহযোগিতা করেছিলেন। আশরাফুল হুদা টিটো জানিয়েছেন, তিনি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ পেয়েছেন। সিটিতে অন্য প্রতিষ্ঠানও আলোকায়নের কাজ করেছে।
তার প্রতিষ্ঠানের কাজের মান ও অন্য প্রতিষ্ঠানের কাজের মান দেখলেই দরের পার্থক্য বোঝা যাবে বলে দাবি তার। হ্যারোর মতো রাসিকের উন্নয়ন কাজে কারিশমা দেখিয়েছে রিথিন এন্টার প্রাইজ। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রায় সব ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন রিথিন এন্টারপ্রাইজের মালিক তৌরিদ আল মাসুদ রনি। তিনি মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। শুধু অঢেল টাকা আর লিটন পরিবারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কারণে তার একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন অস্ত্রহাতে হামলায় অংশ নিতে দেখা যাওয়ার দাবি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। নগরীর বোয়ালিয়া থানায় হওয়া একাধিক মামলার আসামিও রনি। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক আছেন।