জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথা এখন ভাবছে সরকার। আগে কেন ভাবেনি? আগে কেন নিষিদ্ধ করেনি? আগে দরকার পড়েনি। এখন তাহলে পড়েছে দরকার! কেউ কেউ তো বলছে, কোটা আন্দোলনের প্রায় ২০০ জন ছাত্রহত্যা থেকে নজর সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। জানি না, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার পেছনে আসল কারণ কী। ছাত্র আন্দোলনের ভিতরে ঢুকে গিয়ে তারা সহিংসতা করেছে বলে? সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও কি শুধু জামায়াতে ইসলামীই করেছে? দোষ সবাই করলেও জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, কারণ তারা পুরনো পাপী। কিন্তু এই দলটিকে নিষিদ্ধ করলে কি দলটির সদস্যরা জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করবে না? যা বাকি আছে পুড়ে ছাই হতে, পুড়িয়ে দেবে না? আমার প্রশ্ন জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা বা সদস্যরা কজন আর জামায়াতে ইসলামী নামের দলটিতে রয়েছে, অনেকেই তো ঢুকে গেছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলে, বিএনপিতে, জাতীয় পার্টিতে, এমনকী আওয়ামী লীগেও। যখন তৃণ ছিল এই দলটি, উচিত ছিল তখনই নিষিদ্ধ করা, কারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কোনো দেশের জন্য মঙ্গলময় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দেশকে ধ্বংস করে ফেলে। গণতন্ত্রকে, বাক-স্বাধীনতাকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তখন দেশ আর দেশ থাকে না। অঙ্গারে পরিণত হয়।
জামায়াতে ইসলামী নামে কোনো দলকে নয়, নিষিদ্ধ করতে হবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, তাহলেই নিষিদ্ধ হবে জামায়াতে ইসলামী এবং বন্ধ হবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। জামায়াতে ইসলামী একা নয়, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও করছে। দীর্ঘদিন থেকেই নির্বিঘ্নে করছে। জামায়াতে ইসলামীর পলিটিক্যাল এজেন্ডা জাতীয় পার্টি সফল করেছে কিছুটা, বিএনপি সফল করেছে কিছুটা, এরপর বাকি যেটুকু ছিল, সফল করেছে আওয়ামী লীগ। মডেল মসজিদ নির্মাণ কোনো সেক্যুলার দলের এজেন্ডা হতে পারে না। এ শতভাগ জামায়াতে ইসলামীর এজেন্ডা। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতায় থেকেছে। জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে এমন ভয়ংকরভাবে সমস্ত কিছুর ইসলামীকরণ হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামীর কোনো কাজ আর বাকি থাকেনি। সত্যি বলতে কী, জামায়াতে ইসলামীর যে আদর্শ এবং নীতি, তা সব রাজনৈতিক দলেরই আদর্শ এবং নীতি। পার্থক্য শুধু এটুকুই, ৫৩ বছর আগে, ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল জামায়াতে ইসলামী, বাকি রাজনৈতিক দলের সদস্যরা, যতদূর অনুমান করছি, পক্ষে ছিল।
৫৩ বছর অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে জামায়াতে ইসলামীর শক্ত শেকড় বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। এ এখন মহিরুহের আকার ধারণ করেছে। এর সদস্যরা বড় বড় ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ এবং নানা রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। শুধু তা-ই নয়, অসংখ্য ধর্মীয় সংগঠন এবং গোষ্ঠী এরা তৈরি করেছে। মোটা অঙ্কের অর্থ-সাহায্য পেয়ে সংগঠনগুলো বেশ হৃষ্টপুষ্ট। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হলেও এদের সংগঠন এবং গোষ্ঠীগুলো তো টিকে থাকবে এবং জামায়াতে ইসলামীর আদর্শে বিশ্বাস করা লোকেরাও তো বেঁচে থাকবে। তারা যদি তাদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখে, তাহলে জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী।
জামায়াতে ইসলামী মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কাজ করে। অথবা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড জামায়াতে ইসলামীর মতো কাজ করে। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন তৈরি করেছে বিভিন্ন নামে। এসব সংগঠনের মাধ্যমেই তারা জনগণকে ধর্মান্ধ হওয়ার জন্য মগজধোলাই করবে। জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দল থেকে তারা যা করত বা করতে চাইত, একই কাজ তারা অন্য প্ল্যাটফরম থেকে করবে। শুধু তাই নয়, তারা অন্য কোনো নামে রাজনৈতিক দলও শুরু করতে পারে, যে দল থেকে তারা একই রকম কার্যকলাপ করে যেতে থাকবে। সরকার চাইলে সহিংসতার কারণ দেখিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে হয়তো নিষিদ্ধ করতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় না দল নিষিদ্ধ করে সত্যিকার কোনো লাভ হবে।
জিহোভা’স উইটনেস, বাহাই, আহমদি এই ধর্মগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে ৪১টি দেশ। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের ওপর নির্যাতন চালানো বা ধর্ম পালন করতে বাধা দেওয়ায় এগিয়ে আছে বার্মা, চীন, ইরেত্রিয়া, সৌদি আরব, সুদান, উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, ইরান ইত্যাদি দেশ। ধর্ম পালনের অধিকার মানবাধিকারের অংশ। কিন্তু নিজের ধর্ম অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা, অন্যকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সম্পূর্ণই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। পৃথিবীর ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি জন্ম দেয় ধর্মীয় মৌলবাদীদের। ধর্মীয় মৌলবাদীরা সমাজকে অন্ধকারে ফেলে রাখতে চায়, তারা নারীর অধিকারে তো নয়ই, মানবাধিকারেই বিশ্বাস করে না, তাদের মতের সঙ্গে যারা একমত নয়, তাদের বাক-স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না। আমি বহুকাল থেকে বলছি, ধর্মীয় মৌলবাদীরা প্রচণ্ড ঘৃণা করে নারীকে। প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কি ধর্মই কায়দা করে শিখিয়েছে নারীকে ঘৃণা করতে? ধর্মীয় আইন নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয় না। ধর্ম যদি প্রাপ্য সম্মান দেয়, তাহলে ধর্মীয় আইন দেবে না কেন? ঈশ্বর বা ভগবান বা আল্লাহ কি তাহলে নারী আর পুরুষকে সমান চোখে দেখেন না? যে দেশগুলোয় ধর্মীয় আইন আছে, সে দেশগুলোয়, ধর্মীয় আইন নেই এমন দেশগুলোর তুলনায় মেয়েরা বেশি নির্যাতিত। যদি ধর্ম, ধর্মীয় আইন, ধার্মিক, ধর্মীয় মৌলবাদ সবাই মেয়েদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে সরব হয়, তাহলে সেই ধর্ম নিয়ে যেমন বিতর্কের প্রয়োজন আছে, ধর্মীয় বা শরিয়া আইনকে মানুষের মঙ্গলের জন্য বিদেয় করার প্রয়োজন আছে। ধার্মিক বা ধর্মীয় মৌলবাদীদের তো বিদেয় করা যাবে না। তাদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে হবে, তাদের শিক্ষিত করতে হবে। তাদের নারীবিদ্বেষ দূর করতে হবে।
প্রতিটি পরিবারে, পাড়ায়, প্রতিটি সমাজে, সংগঠনে, বিকট আকারে ঢুকে গেছে ধর্ম। জামায়াতি মানসিকতার লোক বিভিন্ন লেবাস পরে কায়দা করে ঢুকিয়েছে, অথবা ধর্মের জিকির তুলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই ঢুকিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? কোনো উপায় নেই। শরীর কিছুটা পুড়ে গেলে বাঁচানো যায়, কিন্তু অনেকটা পুড়ে গেলে আর বাঁচানো যায় না। বাংলাদেশকেও, আমার আশঙ্কা, ধর্মান্ধতার কবল থেকে বাঁচানো যাবে না।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নিষিদ্ধ করা উচিত। যে যুগে ধর্মীয় রাজনীতি চলত, এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পুরোহিতরা ধর্মীয় আইনে দেশ শাসন করত, সেই যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ (ফধৎশ ধমবং)। ইউরোপে যখন গির্জার অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ করেছিল, গির্জার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিল দেশ শাসনের দায়িত্ব, রাষ্ট্রকে আলাদা করেছিল ধর্ম থেকে, তখন থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেক্যুলার রাষ্ট্র। সেক্যুলার রাষ্ট্রে মানুষের ধর্ম পালন করার অধিকার আছে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার নেই। সেক্যুলার রাষ্ট্রে নারী পুরুষ উভয়ের অধিকার সমান। আধুনিক রাষ্ট্র হতে গেলে রাষ্ট্রকে সেক্যুলার হতেই হয়। কোনো রাষ্ট্রধর্ম বহনকারী রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র বা সভ্য রাষ্ট্র হতেই পারে না।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু রাষ্ট্রধর্মও বাতিল করতে হবে। একটি আরেকটির অঙ্গ, একটি না থাকলে আরেকটি থাকার কোনো যুক্তি নেই।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ না করার আন্দোলনে বহুদলীয় গণতন্ত্রে এবং বহুমত প্রকাশে বিশ্বাসীরা যোগ দিতে পারে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক কোনো দেশই আপত্তি করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। এটি নিষিদ্ধ করলে কোনো রাজনৈতিক দলই ভোটের আগে মসজিদ গড়ব, মাদ্রাসা বানাব, মাদ্রাসার ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমান করে দেব, পাঠ্যবই থেকে অমুসলিমদের লেখা উড়িয়ে দেব, মদিনা সনদে দেশ চালাব, দেশজুড়ে ৫৬০টি মডেল মসজিদ বানিয়ে দেব ইত্যাদি বলতে পারবে না। এগুলো হবে নিতান্তই ভোটে জেতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা। যা হবে আইনত নিষিদ্ধ। মৌলবাদী তোষণের রাজনীতি বহু যুগ ধরে বাংলাদেশে চলছে, এই তোষণ রাজনীতিকে বড় দুর্গন্ধময় করে তোলে। জামায়াতে ইসলামীকে যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে ধর্মের রাজনীতি বাদ দিয়ে ধর্মগন্ধহীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি অর্থনীতি ইত্যাদি উন্নয়নের লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। শুধু জামায়াতে ইসলামীকে নয়, সব রাজনৈতিক দলকেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য দল আর জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে নীতিগতভাবে খুব একটা পার্থক্য নেই।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা