কয়েক সপ্তাহে কোটার সংস্কার চাওয়া প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা জয়ী হয়নি। জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি। জয়ী হয়েছে বৈষম্যের পক্ষের শক্তি। পরাজয় ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৃষ্ট বাংলাদেশের। কীভাবে সেই পরাজয় ঘটল সে সম্পর্কে আমার উপলব্ধি তুলে ধরার জন্যই এ লেখা। শুরুতেই সারা দেশে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ব্যাপক জীবনহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের রূপ ও তার প্রেক্ষাপট নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণে তুলে ধরব।
প্রধানত কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনটির ব্যাপকতা ছিল, প্রচণ্ডতাও ছিল। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ কোটার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চাইলেও তাদের অধিকাংশ চেয়েছিল কোটাব্যবস্থার সংস্কার। তারা যে সংস্কার চাইবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। সেই ২০২২ সালেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছিল, সারা দেশে প্রায় ৮ লাখ শিক্ষিত বেকার নর-নারীর সংখ্যার কথা। তারা দেখেছে, কীভাবে সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়েছে। দেখেছে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও স্থান পেয়েছেন, কীভাবে অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কেনা যায়। তাই আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কোটার সংস্কার চাওয়ার দাবি অস্বাভাবিক ছিল না। তাছাড়া আরও বহু কারণে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। তরুণ প্রজন্ম একদিকে দেখেছে করোনা মহামারির ভয়াবহতার কালেও চোখে দেখা যায় এমন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। অন্যদিকে তারা দেখেছে কীভাবে গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। মন খুলে যে কেউ কথা বলবে, সত্য উচ্চারণে ভয় পাবে না, সেই পরিবেশ অনেকদিন ধরেই নেই। বছরের পর বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগের হাতে তাদের দাসত্বের কথা, পদে পদে নিগ্রহের কথা মনে করে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের প্রায় ভোটারশূন্য নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার পুরোপুরি কেড়ে নেওয়ার ইতিহাস তাদের ক্ষুব্ধ করেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিচালনাকালে বল প্রয়োগের পথে না গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা সুবিবেচনা দেখালেও, সরকার তা দেখায়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘ছাত্র আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ যথেষ্ট’ বলে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর নানা অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বেধড়ক পিটুনি, আহতদের হাসপাতালে গিয়ে আক্রমণ, আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কাজটি করেছিল। বাস্তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত না করলেও, জনৈক সাংবাদিকের অযাচিত অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব ছিল অসাবধানী ও ক্ষতিকর। হাজারো ছাত্রছাত্রী ধরে নেয় যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি ছাড়া সবাইকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একদিকে ছাত্রলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ আক্রমণ, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধীদের উসকানি- সব মিলিয়ে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তাদের আন্দোলনের প্রচণ্ডতার মুখে ছাত্রলীগসহ সরকারি দলের সংগঠনগুলো মাঠ ছেড়ে দেয়। কার্যত আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো করায়ত্ত করে নেয়। টানা দেড় দশক ধরে যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নিগৃহীত, অত্যাচারিত হয়েছে, তাদেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বিতাড়িত করে আন্দোলনকারীরা। তবে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সে বিজয়ের পাশাপাশি পুলিশ, বিজিবি ও অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ, যুবলীগের যৌথ আক্রমণে শত শত ছাত্রছাত্রী আহত হয়। বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়।
অনেকের মনে আশঙ্কা ছিল, শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনকে অশান্ত অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলে তার সুযোগ নেবে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে ছাত্রদের বিপুল শক্তির আন্দোলনকে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সৃষ্ট চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বাংলাদেশবিরোধী শক্তির সক্রিয় হওয়ার কাক্সিক্ষত পথ খুলে দেয়। একদিকে তারা জনগণের সম্পদ ধ্বংস করে, অন্যদিকে সরকার, রাষ্ট্র এবং আওয়ামী লীগের নানা স্তরে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশে লাখ কোটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য কমানোর একটি রক্ষাকবচ কোটাব্যবস্থার কবর রচনা করে এবং তাদের এ বিজয়ের জন্য মাত্র কয়েকদিনের সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আক্রমণে ঝরে যায় অন্তত ২১০ জন মানুষের প্রাণ, যাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষ।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রম, ঘাম, আত্মত্যাগ ও তাদের অর্জিত অর্থে গড়ে ওঠা গর্ব করার মতো সম্পদ কয়েকদিনের মধ্যে ভস্মীভূত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশবিরোধী শক্তির হাতে। তাদের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু ছিল সাধারণ কর্মজীবী মানুষের প্রিয় মেট্রোরেল, নিমেষে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে দূরবর্তী আরেক প্রান্তে নিয়ে যাওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিটিআরসির ডেটা সেন্টার, নদীমাতৃক বাংলাদেশের যাতায়াতে অপরিহার্য সেতুর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কেন্দ্র রাষ্ট্রীয় সেতু ভবন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারের মূল কেন্দ্র রামপুরার বিটিভি ভবন। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, গুলি চালিয়েছেন, নিহত হয়েছে বহু প্রাণ, তারা নিজেরাও কয়েকজন নিহত হয়েছেন, আহতও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু ওপরে বর্ণিত দেশের সম্পদ রক্ষায় তারা এগিয়ে যাননি। অনেক জায়গায় থানার ওসি ও পুলিশ অবরুদ্ধ অবস্থায় নিজেদের নিরাপদ করেছেন, দেশের সম্পদ রক্ষায় সাহস করে বের হননি। অবাক বিস্ময়ে টিভির পর্দায় আমরা দেখেছি এলোমেলো বোতাম খোলা সিভিল পোশাকে বিপর্যস্ত নরসিংদী কারাগারের জেলারকে। গভীর অসহায়ত্বের সঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, সন্ত্রাসীরা কারাগারের মূল গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেছে, কারারক্ষীদের একজনকে হত্যা এবং অনেককে আহত করেছে, জঙ্গি আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ও জেএমবির ৯ জন শীর্ষ জঙ্গিকে লকআপ ভেঙে মুক্ত করেছে, আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুলসংখ্যক গুলি, ব্যারাকের সিপাহিদের টাকা-পয়সা, রেশনসামগ্রী নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে ৮১৬ জন কারাবন্দিও কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে। তিনি বলছেন, কতজনকে ফোন করেছি, কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। নরসিংদীর পুলিশ সুপারকে সাহায্যের কথা জানোনোর পরও সাড়া পাননি। সুপার বলেছেন, ‘আমরা নিজেদের বাঁচাতে পারি না, নিজেদের বাঁচান’। সবাই নিজেদের বাঁচিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের বিপুল ক্ষমতার অধিকারী আত্মীয়স্বজন, তাঁর বিশাল রাজনৈতিক দল, সুবিধাপ্রাপ্ত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার দল নিজ নিজ সুরক্ষিত আস্তানায় নিজেদের বাঁচিয়েছেন অথবা বিপদের গন্ধ শুঁকে সুযোগমতো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ সংবাদপত্রের একজন রিপোর্টার যেমন বলেন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে- তা মেনে এ ধ্বংসলীলা চলতে দিয়েছে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় থাকা মহা-শক্তিশালী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও লীগ নামটি যুক্ত বহু ভুঁইফোড় সংগঠন। দেশবিরোধী শক্তির হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানোর লড়াই মোকাবিলা না করে এসব সংগঠনের নেতারা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন যেমনটা অতীতেও দেখা গেছে; বিশেষ করে ২০০৭ সালে সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ কি কেবল বাংলাদেশবিরোধী জামায়াত-শিবির-জঙ্গিদের হাতে ধ্বংস হয়েছে? গভীর পরিতাপের কথা, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশবিরোধী শক্তিও জনগণের সম্পদ ধ্বংসে ইন্ধন জুগিয়েছে অথবা সরাসরি যোগ দিয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষের জীবন হরণ ও জনগণের সম্পদ ধ্বংসেই সব ক্ষয়ক্ষতি সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২৩ জুলাই ২০২৪ সুপ্রিম কোর্টের বহুল আলোচিত রায়ের পরদিন রায়ে ঘোষিত কোটাবিষয়ক সবকিছু মেনে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হলো- মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা সন্তানদের জন্য ৫% কোটার ব্যবস্থা থাকবে। এ কোটার সুবিধা বয়সের বিবেচনায় সেই সন্তানরা যে পাবেনই না এবং এ কোটার পুরোটাই যে শেষমেশ তথাকথিত মেধা কোটায় যুক্ত হয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই যে নানারকমের সুবিধাভোগী ধনিক শ্রেণি থেকে আসেননি, স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যে ঘটেনি, তাঁদের যে বহু দশকজুড়ে সাহায্য করা তো দূরে থাক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ স্মরণ না করার কারণে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধারা যে আজ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অংশ, তা জ্ঞানীগুণীজন বা স্বনামধন্য আইনজীবীগণ ভুলে গেছেন। বহুকাল ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিদারুণ বৈষম্যের শিকার নারীদের জন্য কোটাও সরকার বিলুপ্ত করে দিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথাও কেউ মনে রাখল না। ভুলে যাওয়া হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ গরিব জনগণকে, যাদের জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে এবং সর্বস্তরে ব্যাপক আকারে কোটার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের বহু তারকা এসব দেখেও না দেখার ভান করে নিশ্চুপ থাকলেন। অন্যদিকে একেবারে নামকাওয়াস্তে আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সর্বমোট ২% কোটার বিধান রাখা হলো। দুঃখজনক হলেও এটাই চরম সত্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের এ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোটাব্যবস্থা কার্যত বিলুপ্ত করে বাংলাদেশে লাখ কোটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এক ধরনের রক্ষাকবচ এফারমেটিভ অ্যাকশন-এর কবর রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বুকে এ গভীর ক্ষত সৃষ্টির দায় কার? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের সম্পদ ধ্বংসের দায় বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গিদের নিতে হবে। জনগণের সম্পদ ধ্বংসে বাংলাদেশবিরোধী শক্তির দায় আছে বৈকি। প্রশ্ন থাকে, কোন বিবেচনায় একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে লেলিয়ে দেওয়া হলো? কোন বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের সম্পদ ধ্বংসে যারা লিপ্ত তাদের না ধরে এখনো সাধারণ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করছে? কীভাবে বেআইনিভাবে ঘর থেকে তুলে নেওয়ার পর ছাত্রদের স্পষ্টতই নির্যাতন করা হচ্ছে? নিরাপত্তার নামে জোর করে ডিবি অফিসে নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়কদের সব আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়ানো হচ্ছে? এমন অভিনব ঘোষণার স্বপক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডিবির মহাশক্তিশালী অতিরিক্ত কমিশনার যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, ছাত্রসমাজ তো বটেই, সাধারণ মানুষও এমন ঘোষণাকে কেন আস্থায় নেবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সুযোগ পেলেই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, আপনার হারানোর কিছু নেই, কারণ আপনি সব হারিয়েছেন। আপনার কথা সত্য। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় যে আরও অন্তত ২১০টি পরিবারও তাদের অতি প্রিয়জনদের চিরতরে হারিয়েছে, তা আপনি উপলব্ধি করুন। এ কথা তো সত্য যে, এক দিন জনগণের ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদ পুনর্নির্মাণ হবে, বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে কোটাব্যবস্থার সত্যিকার সংস্কারও হয়তো এক দিন হবে। কিন্তু যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের একজনকেও কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে? বাংলাদেশে স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীন বৃহত্তর জনগণের সঙ্গে বিপুল বিত্তের অধিকারী ক্ষুদ্রাংশের যে প্রকট বৈষম্য বর্তমান এবং যার কারণে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে অঙ্গীকার ছিল আমাদের সংবিধানে, তার বড় পরাজয় ঘটে গেছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, আন্দোলনে অমিত তেজ এবং আবেগে অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা দেখবে কীভাবে সরকার মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে এমন এক অনাকাক্সিক্ষত বিজয় ও অপরিমেয় পরাজয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কারণ সুবিধাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যাদের মধ্যে নারীরা তো বটেই, বাংলাদেশের কৃষক, মজুর এবং বিদেশে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সে উন্নয়নের চাকাটি ঘোরে এবং অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা যারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাতারেই আছেন, তারা সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রজ্ঞাপনে প্রতারিত ও পরাজিত হয়ে গেছেন। সেজন্যই বাংলাদেশের পরাজয়। এভাবেই কোটাবিরোধীদের এমন বিজয়ের উল্টোদিকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হেরে গেছে।
এ পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে সামনের দিনগুলোতে আরও বিস্তৃত আন্দোলন, ধ্বংসযজ্ঞ, অচলাবস্থা এবং তাকে ঢাল হিসেবে নিয়ে আবারও অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখলের পুরনো চক্রে পতিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে হতভাগ্য বাংলাদেশে। এমন এক ধূসর ও অনাকাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা কি রাখে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ? অবশ্যই রাখে। যেখানে সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা চেয়ে রিট পিটিশন দায়ের করেন, যেখানে এখনো কিছু শিক্ষক আছেন যারা আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে প্রকাশ্যে এবং সাহসের সঙ্গে অবস্থান নেন, সেখানে আশাবাদী হওয়ার কারণ অবশ্যই আছে। অতীতে বাংলাদেশের হার না মানা সংগ্রামী মানুষ ও নতুন প্রজন্মের সাহসী তারুণ্য তেমন নিরাশার এবং অন্ধকারের ভবিষ্যৎকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। সূচনা করেছে নতুন আশার, সন্ধান দিয়েছে এমন আলোকিত নতুন পথের, যা তাদের নিয়ে গেছে বড় বিজয়ের দিকে। বাংলাদেশ জনপদে তেমন বিজয় আমরা দেখেছি ১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৩ সালে। কোটাব্যবস্থার সংস্কার ও অন্যান্য দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে উদ্দেশ্য করে বলব, তোমাদের তেজ ও সাহস আমাদের বুকেও এ বৃদ্ধ বয়সে সাহস সঞ্চার করে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণকালে তোমরা ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞা কর, যাতে তোমাদের সংগ্রামে বাংলাদেশবিরোধীরা সুযোগ নিতে না পারে। তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিই অতি প্রয়োজনীয় কোটাব্যবস্থার সত্যিকারের সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা, যার দাবি তোমরাই তুলেছিলে। আন্দোলন চলাকালে তোমরা নিজেরাই নিজেদের রাজাকার ডাকার স্লোগান দ্রুত সংশোধন করেছিলে। চরম অভিমানেও আর কখনো নিজেদের রাজাকার ডেকো না। মনে রেখ, তিরিশ লাখ শহীদের অপমান যাতে না হয়, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পরাজয় যাতে চিরস্থায়ী না হয়, তা প্রতিরোধ করার পবিত্র দায়িত্ব তোমাদের প্রজন্মেরই।
১৯ জুলাই, ২০২৪ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং অতঃপর’ লেখায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম, এখনো সময় আছে আন্দোলনরত ছাত্রদের কাছে টেনে নিয়ে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আলোচনা শুরু করতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সেই আহ্বানে সাড়া দেননি অথবা আপনার নজরেও কেউ তা আনেননি। ২০১২ সালে প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর লিখেছেন : ‘মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে’। জাতির পিতার কথাগুলো বর্তমান বাংলাদেশের জন্য বড় সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পর জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট, তা কার্যকর হয়েছে। বহু দেরিতে হলেও এ সঠিক সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে তখনই, যখন ওই কালো শক্তিকে শুধু রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা নির্মূল করা নয়, ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করবেন এ যুদ্ধে। একই সঙ্গে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের দল, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান শুরু করবেন; আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণ চালানো তাঁর দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনবেন। কলুষিত ছাত্র রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে ছাত্র সংগঠনগুলোকে মূল দল থেকে বিযুক্ত করে, সরকারি বাতাবরণ থেকে সরিয়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা করবেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ মেরামতের কাজ ব্যাপক সংস্কার ছাড়া কখনোই সম্ভব হবে না। পরবর্তী লেখায় সে বিষয়ে আলোকপাত করার প্রত্যাশা করছি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাক্তন ইউজিসি
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়