হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বিভিন্ন ধরনের মনকাড়া স্লোগান তৈরি করেছে। তারা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী আলহাজ গেটে ত্রিমুখী রাস্তায় কিছু স্লোগান লিখেছে : যেমন- ১) এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে; ২) দেশ আমাদের, দায়িত্ব আমাদের; ৩) জনতা হোক সরকার; ৪) আমাদের ঈশ্বরদী, গড়ব আমরা ইত্যাদি। আমি মনে করি- ‘জনতা হোক সরকার’ স্লোগানটি সব কথার শীর্ষে। আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের যে চিরন্তন বাণী দিয়েছিলেন সেটা একটু স্মরণ করা যাক- গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার। সব মনীষী মত দিয়েছেন- এ স্লোগান পৃথিবী থেকে কোনো দিন মুছে যাবে না। আমাদের নতুন প্রজন্ম সে কথারই যেন সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরেছে। যারা রাজনীতি করেন, গবেষণা করেন, এমনকি আমার মতো যারা লেখালেখি করেন, তারা কি কখনো তাদের মন মেজাজ বোঝার চেষ্টা করেছেন? তারা তো ভিনদেশের প্রজন্ম নয়, আমাদেরই সন্তান। তাদের কাছে বসে কখনো কি একটু আদর করে জানতে চেয়েছি তারা কী চায়? প্রথমে আমি নিজের কথা বলি। আমার মেজো কন্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ে। আমার ইচ্ছা সে যেন আমার স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষণাটি একটু মনোযোগ দিয়ে শোনে। যখনই তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে গেছি তখনই সে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছে- ওসব আমার জানা আছে। তাদের ভিতরে যে এক ধরনের দ্রোহ কাজ করছে তা বোঝার চেষ্টা করিনি। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় একটি সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে- যা একপর্যায়ে গণবিক্ষোভে রূপ নেয় এবং ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে।
সরকার সেই ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। তখন তারা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন শুরু করে। আগে করেছে ঢাকা শহরে, এবার তারা সারা দেশে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছে। লক্ষ্যণীয়, তাদের স্লোগানগুলো প্রথমে ছিল কোটাবিরোধী। তারপর বৈষম্যবিরোধী নানা প্রকার স্লোগান দিতে থাকে। একসময় দ্রোহ শব্দটি যুক্ত হয়। তারা নানা কারণে বিক্ষুব্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামক দানবদের অত্যাচার, শিক্ষকদের চামচামো, প্রশ্নপত্র ফাঁস, চাকরি নিতে ঘুষ, শিক্ষাবাণিজ্য, অফিস-আদালতে দুর্নীতি, সারা দেশে পরিবারতন্ত্র, ভোট দিতে গিয়ে অপমানিত হওয়া, এরকম শত শত অনিয়ম তাদের বিদ্রোহী করে তুলেছে। কথা হচ্ছিল ‘জনতা হোক সরকার’ স্লোগানটি নিয়ে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়।
সরকার পতনের আগে পুলিশ ও সরকারদলীয় পাণ্ডাদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে ৩ শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাদের মধ্যে শিশু, গৃহবধূ, হকার, পথচারীসহ সাধারণ জনগণ রয়েছে। শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। সরকার পতনের পর একশ্রেণির পরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রবণ মানুষের ইন্ধনে বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবন, সংসদ ভবনে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সব ভাস্কর্য ধ্বংস করে দেয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যবাহী ৩২ নম্বরের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িসহ সংখ্যালঘুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। থানা ও জেলখানায় আক্রমণ করে। এতে ৪০-৫০ জন পুলিশ সদস্যসহ ২ শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। ৬, ৭, ৮ আগস্ট শাসন ব্যবস্থা অচল ছিল। পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতি শুরু করে (এ লেখা পর্যন্ত বহাল রয়েছে)। আমরা যদি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে তাদের থেকে আমাদের মূল্যবোধ কোনো অংশে কম নয়।
আমরা জানি, আমেরিকায় সিসিটিভি ক্যামেরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলে লুটপাট ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সারা দেশের বেআইনি কর্মকাণ্ডগুলোর শতকরা হিসাব করলে সম্ভবত ০.৫০% হবে, তথা ৯৯.৫০% মানুষ এখনো মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আমরাই আমাদের প্রতিবেশীকে রক্ষা করেছি। এখন দরকার আমাদের মূল্যবোধ চালিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার। সেজন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ সর্বস্তরে গণতন্ত্র বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই হবে জনতার সরকার।
লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক