শৈশবই হচ্ছে মানব জীবনের সিংহদ্বার। জীবনের সুদীর্ঘ পথের শুরু এ শৈশবেই। এ সময়ের শিশুচিত্ত প্রভাতের স্নিগ্ধ রবি কিরণের মতোই স্বচ্ছ, পবিত্র। শৈশবই সে গঙ্গোত্রী যেখান থেকে পুণ্যসলিলা জীবনজাহ্নবীর যাত্রাপথের শুরু। তাই জীবনের শুরু এ পুণ্য মুহূর্তকে সঠিক দিশা দিতে পারলেই জীবনজাহ্নবীর সঠিক পরিণতি সম্ভব। আজকের শিশুই ভবিষ্যতের নাগরিক। শিশুর কোমল দুটি কাঁধের ওপরেই গোটা জাতির ভবিষ্যতের অট্টালিকা দণ্ডায়মান। মানব জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার দায়ভার শিশুর ওপর নির্ভরশীল। আর শিশুকে এ দায়ভার বহনের যোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সমাজের, বর্তমান প্রজন্মের। জীবনের এ ঊষালগ্নের গুরুত্ব অনুমান করেই প্রাচীন ভারতবর্ষ শৈশবকালে ব্রহ্মচর্য পালনের নির্দেশ দিয়েছিল। সে যুগে রাজকুমার থেকে সাধারণ বালক, সবাই গুরুগৃহে গুরুর তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করতেন। একে বলা হতো গুরুকুল প্রথা। এ গুরুকুলে শিশুর শিক্ষাগত বিকাশের সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, চারিত্রিক ইত্যাদি সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিদান করা হতো। তাই শৈশবেই একটি সুন্দর জীবনশৈলীর নির্মাণ সম্ভব হতো। কিন্তু জীবনের এ অতি মূল্যবান সময়ের গুরুত্ব যা আমাদের পূর্বস-রিরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং যাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলাম আমরা, তাঁদের উত্তরসূরিরা, সে দিকটিকে সযত্নে উপেক্ষা করে যাই। তাই তো জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে যায় কারখানার যন্ত্রের বিষবাষ্পে। ছোট্ট, কোমল হাত দুখানি যন্ত্রের নির্মম আঘাতে জর্জরিত। শিশু বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সরল নিষ্পাপ একটি মুখ। যাতে চাঁদের হাসি ঝরে কিন্তু হƒদয়হীন সমাজের নিষ্ঠুরতায় সে মুখ আজ পরিশ্রমের কালিমা লিপ্ত। চাঁদের হাসিতে গ্রহণ লাগে শিশু শ্রমরূপী রাহুর করাল ছায়ায়। এ কালিমা, অকালের এ গ্রহণ, মানবতার লজ্জা। এ লজ্জা আধুনিক সমাজের মুখে কলঙ্করেখা। এ লজ্জা, এ কলঙ্ক মোছার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আজও তা বিরাজমান এবং চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিষ্ণু। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত পরিসংখ্যান তার স্বপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা লক্ষাধিক। তারা বিভিন্ন বিপজ্জনক শিল্পে কাজ করছে যা তাদের শারীরিক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড হানিকর। এভাবেই দিয়াশলাই শিল্প, আতশবাজি তৈরির কারখানা, বিভিন্ন রত্ন খোদাই এবং পরিষ্কারের কারখানা, কাচ শিল্প, কার্পেট শিল্প ইত্যাদি আরও কত শিল্প উদ্যোগ ও কারখানার যূপকাষ্ঠে আমাদের দেশের লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ আমরা বলি দিচ্ছি। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, দেশের শিশু শ্রমিকের ১০ শতাংশই বালিকা, তারা প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরিতে দিনে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করছে। আমাদের দেশে ক্ষতিকারক শিল্প উদ্যোগগুলোতে শিশু শ্রমিকদের নিযুক্তি আইনত নিষিদ্ধ।
আফতাব চৌধুরী