প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর একটি প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ পালন করা হয়। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘আমাদের সম্প্রদায় এবং প্রতিবেশীদের শক্তিশালী করা’। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রবীণদের বঞ্চনা, বৈষম্য, অধিকারহীনতা, মর্যাদাহীনতা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বেই তাদের এই দুরবস্থা কমবেশি বিদ্যমান।
পরিসংখ্যান বলে বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশের অধিক প্রবীণ। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি প্রবীণ আছেন। এটা ২০২৫ সালে হয়ে যাবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যাটা দাঁড়াবে সাড়ে ৪ কোটিতে। তখন দেশে শিশুদের চেয়ে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ২০১৩ সালে সরকার জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা তৈরি করলেও পরিবার বা সমাজে এই নীতিমালা এখনো তেমন কার্যকর হয়নি। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুসারে, বাংলাদেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। তবে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে ৫৬ বছর বয়সি ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি জনসংখ্যার অনুপাত ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে ১ কোটি ৪ লাখের বেশি হয়েছে। যা আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৬৫ বছরের বেশি বয়সি মানুষের নির্ভরতা অনুপাত ২০২২ সালের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নির্ভরতা অনুপাত মূলত জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর একটি পরিমাপক। এটি অর্থনৈতিকভাবে অন্যদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত।
কয়েক বছর ধরে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ এই জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশিত জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিতে পারবে কি না। কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হয় অর্থাৎ পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বেশি হয় তখন সেই অনুপাতকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ বলে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের মতে, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি মানুষকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সি মানুষ তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাভোগী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বর্তমানে শতকরা ৬৮ ভাগ মানুষ এখন কর্মক্ষম আর বাকি ৩২ ভাগ পরনির্ভরশীল। এ কারণে বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মতো সুবর্ণ সময় পার করছে, যা ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা আছে, নিম্ন মধ্যম-আয়ের বাংলাদেশ তা পূরণে প্রস্তুত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। যত দিন যাচ্ছে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কিন্তু সংকুচিত হয়ে আসছে। এটা কমে গেলে নির্ভরশীলতার অনুপাত বাড়বে। পরিসংখ্যানের ফলাফল প্রবীণদের বিষয়ে দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো দেশের প্রবীণ বা নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তখন তাকে প্রবীণ সমাজের দেশ বলা হয়। সেই হিসেবে ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি প্রবীণ সমাজের দেশে পরিণত হবে। যদি এই হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তখন জাতিকে প্রবীণ সমাজের জাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমাদের দেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ৬৫ বছরের বেশি বয়সি জনগোষ্ঠীর অংশ বাড়বে। তার মানে এই গোষ্ঠীকে শ্রমবাজারের সঙ্গে জড়িত রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে। বয়স্ক জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির কারণে যে সমস্যাগুলো দেখা দিবে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, তরুণ জনগোষ্ঠী যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড দেয় তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না। জনসংখ্যার একটি অংশের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ হবে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৬০ বছর ও তার বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। এটি অবশ্য বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি। তাদের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা নিয়ে আগে থেকেই চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করতে হবে। প্রবীণ জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি সরকারের বাজেটের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে, কারণ বিশ্বের সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।
পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত কমবে এবং প্রবীণ জনসংখ্যার অনুপাত বাড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষম মানুষের অনুপাত কমে আসবে। এজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যগত জটিলতা বাড়তে থাকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা কাজ ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা একাকিত্বেও ভোগেন। গ্রামাঞ্চলেও নিঃসঙ্গ প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৩ সালে সরকার প্রবীণদের জন্য যে জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে যেখানে সন্তানদের জন্য পিতামাতার দেখভালের দায়িত্ব বাধ্যতামূলক করা হয়। এটা না মানলে শাস্তির আওয়তায় আনা হবে বলে নীতিমালায় বলা আছে। যতদূর জানা যায়, এ দুটির কোনোটিই বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। প্রবীণদের ঘর ও অন্যান্য সুবিধা দিতে বেসরকারি খাত ও এনজিওগুলোর বিভিন্ন উদ্যোগ আছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানসম্মত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে।
এই দিবসটি উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বয়স্কদের প্রতি বৈষম্য ও অশোভন আচরণ দূর করা। বর্তমান জীবনধারা এবং ছোট পারিবারিক সংস্কৃতিতে বয়স্কদের সুস্থ ও সুখী রাখা আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র আজ বার্ধক্যে উপনীত মানুষ চরম অসহায়। মা-বাবা সন্তানকে শুধু মানুষই করেন না, তাঁর জীবনের সকল সঞ্চয়ও বিলিয়ে দেন। অথচ তারাই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বৃদ্ধাশ্রমে অতিবাহিত করেন। অসহায় হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেন। সন্তানকে সবকিছু দিয়ে নিঃস্ব হয়ে তাদের স্থান হয় খোলা আকাশের নিচে। বাংলাদেশের আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের মর্যাদাসহ বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু, প্রবীণরাই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। প্রবীণরাই প্রস্তুত নন। যার ফলে জীবনের শেষপর্যায় বৃদ্ধাশ্রমে অতিবাহিত করেন আর মৃত্যুর প্রহর গোনেন। প্রবীণদের জীবনে অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিকূল ও বিরূপতাকে সহ্য ও উত্তীর্ণ হওয়ার সক্ষমতা প্রয়োজন। এই সক্ষমতা অর্জনে নীতিগত, কৌশলগত ও কর্মসূচিগত সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। প্রবীণদের অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, চলাফেরা ও অংশগ্রহণ সহনশীলতা, আন্তপ্রজন্মগত সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ সহনশীলতা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে প্রবীণদের সহনশীলতা বাড়াতে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এই দিনে, সবাইকে কেবল প্রবীণদের প্রতি উদার হওয়ার শপথ নেওয়া উচিত নয়, প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বও বোঝা উচিত।
লেখক : গবেষক