বাগানে যখন ফুল ফোটে ভ্রমর তখন ছুটে আসে। ফুলের চারদিকে ভোঁ ভোঁ শব্দে ঘুরতে থাকে কালো ভ্রমর। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ফুলের সৌন্দর্য দেখে দেখে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করে সে। কারণে-অকারণে সকালে-বিকালে সব সময় ফুলের টানে ফুলের ঘ্রাণে বেকারার থাকে ভ্রমর। ভ্রমরের চেয়েও বেশি বেকারার ছিলেন নবী পাগল সাওবান (রা.)। তিনি ছিলেন দয়াল নবীজির (সা.) গোলাম। কী দিন কী রাত কী দুপুর কী সন্ধ্যা সব সময় নবীজিকে দেখার জন্য পড়ে থাকতেন নবীজির দরবারে। নবীজির মুখের একটু মধুমাখা কথা শুনে প্রশান্তি লাভের জন্য ব্যাকুল থাকত তার কান। চোখে অঝোর রহমত নিয়ে নবীজি তার দিকে তাকাবেন, তাকে কোনো হুকুম করবেন, নবীজির জন্য জীবন কোরবানের সুযোগ আসবে এমন অপেক্ষায় কেটে যেত তার রাতদুপুর-দুপুররাত। প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবি (রহ.) কালবির সূত্রে বর্ণনা করেছেন, ‘রসুলের ভালোবাসায় সাওবানের হৃদয় ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। নবীজির দিদার ছাড়া এক মুহূর্তও তিনি থাকতে পারতেন না। এক দিন নবীজি (সা.) ওয়াজ করছেন। এমন সময় সাওবান (রা.) এলেন। চেহারায় তার বিষণ্ণতার ছাপ। চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ। ঠোঁট দুটো শুষ্ক। শরীর ভেঙে গেছে। দাঁড়াতে পারবেন এ শক্তি পর্যন্ত নেই। হঠাৎ এমন দুর্দশা দেখে নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রিয় ছেলে আমার! তোমার এ অবস্থা কেন? কোনো অসুখ হয়নি তো?’
নবীজির মুখের দিকে তাকিয়ে দরদর কেঁদে ফেললেন পাগল সাওবান। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, ‘নবীজি গো! আল্লাহর কসম! আমার কোনো অসুখ হয়নি। শরীরও খারাপ হয়নি। আমার এমন অবস্থা অন্য কারণে!’
নবীজি জানতে চাইলেন, ‘কী কারণে এমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেলে তুমি?’
সাওবান চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘জীবনের চেয়েও আপনাকে বেশি ভালোবাসি হে নবী! আপনার কদম চুমেছি আর কোনো দুঃখ নেই, কোনো মনঃকষ্টও নেই। কয়েকদিন হলো জান্নাতের কথা মনে করে দুঃখে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। দুনিয়ায় যখন খুশি আপনার দরবারে এসে আপনাকে দেখে মন ভরাতে পারি, ক্ষুধা নেভাতে পারি। কিন্তু জান্নাতে তো সে সুযোগ আমি পাব না। আপনি থাকবেন নবীদের সঙ্গে উঁচু মাকামে। আমি থাকব নিচের জান্নাতে। তখন তো ইচ্ছা হলেই আপনাকে দেখে মনের তৃষ্ণা মেটাতে পারব না। এ কষ্টে আমার শরীর ভেঙে গেছে।’ এ কথা বলতে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, যারা দুনিয়ায় নবীর বাগানে প্রেমের ভ্রমর হবে, আখেরাতেও তারা নবীর সঙ্গে থাকবে। সুরা নেসার ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও রসুলের অনুগত হবে জান্নাতেও তারা রসুলের সঙ্গে থাকবে। তাদের ওপর আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। আর তারা হলেন নবী-সিদ্দিক-শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দারা। সঙ্গী হিসেবে তারা কতই না চমৎকার।’ (তাফসিরে কুরতুবি, পঞ্চম খন্ড, ২৭১ পৃষ্ঠা)। শুধু সাওবান (রা.) নন, সব সাহাবির মনেই ছিল নবীজির প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। ছিল নবীজিকে দেখার ব্যাকুলতা। তাফসিরে মাজহারিতে মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রবিয়া বিন কাব আসলামিকে (রা.) এক দিন রসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রবিয়া! তোমার কোনো ইচ্ছা থাকলে আমাকে বলো। আমি দোয়া করব। তুমি যা চাইবে তাই পাবে।’ রবিয়া মনে মনে ভাবলেন, এই তো সুযোগ। পরম কাক্সিক্ষত জিনিসটি চেয়ে ফেলি। ‘ওগো নবী আমার! আমি আপনার পাগল। আপনাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারি না। আপনি দোয়া করেন আমি যেন জান্নাতেও আপনার কদমে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারি।’
নবীজি বললেন, ‘হে রবিয়া ভেবে বল এটাই কি তোমার চাওয়া?’
রবিয়া বলল, ‘জি হুজুর! এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো চাওয়া হতে পারে না।’
নবীজি মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে বেশি বেশি সেজদা করো যেন তোমার জন্য আমি সুপারিশ করতে পারি।’ (তাফসিরে মাজহারি, তৃতীয় খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা)। প্রখ্যাত তাবেয়ি মাসরুক (রহ.) বলেন, ‘এক দিন সাহাবিরা রসুলকে বললেন, ‘ও গো আল্লাহর রসুল! দুনিয়াতে যখন খুশি আপনাকে দেখে প্রাণ জুড়াতে পারি কিন্তু আখেরাতে কি আপনাকে দেখতে পারব?’। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে সাহাবিরা বলেন, নবীজি আখেরাতে ইচ্ছা হলেই আপনাকে দেখতে পাব না এ কথা ভাবতেই কষ্টে হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। সাহাবিদের এমন আবেগঘন দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে সুরা নিসার ৬৯ নম্বর আয়াত নাজিল করে আল্লাহ জানিয়ে দেন, ‘দুনিয়ার মতো আখেরাতেও নবীজির গোলামির পূর্ণ সুযোগ থাকবে।’ সুবহানাল্লাহ! (মুসান্নিফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নম্বর ১১৮২৩)।
লেখক : প্রিন্সিপাল, আন-নূর মাদরাসা, বাসাবো ঢাকা