কথায় বলে, সহজে পাওয়া ধন মানুষ কদর করে না। মর্যাদা বোঝে না বিনা কষ্টে পাওয়া নেয়ামতের। অন্যদিকে খুব কষ্টে গড়া সামান্য কিছু মানুষ আগলে রাখে বুকের গভীরে। হারাতে দেয় না জীবনের বিনিময়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সম্পদ ইমান। সবচেয়ে দামি রত্ন ইসলাম। আফসোস! জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার কারণে আমাদের কাছে ইমানের দাম নেই বললেই চলে। তাই তো ১০ টাকার বিনিময়ে ইমান বিকিয়ে দিই হাসিমুখে। ১০০ টাকা হাতে এলে আমানতের মুঠো আলগা করে দিই খুশি মনে। হায়! কী দামি রত্ন বুকে নিয়ে ঘুরছি আমাদের কোনো অনুভূতি নেই। এই ইসলামের জন্য অত্যাচারের এমন কোনো মাত্রা নেই যা নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের সহ্য করতে হয়নি। কালো বেলালের কথাই মনে করুন। মরুভূমির গরম বালুর ওপর খালি গায়ে শুইয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি নরপিশাচরা। বুকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে বড় ভারী মোটা পাথর। বালুর তাপে শরীরের মাংস ঝলসে খসে খসে পড়ছিল। তবু বেলাল ভোলেননি আলোর মিনারের কথা। জিহ্বা নাড়িয়ে বলছিলেন- আহাদ! আহাদ! মনে করুন জলিলে কদর সাহাবি হজরত আবু হুরায়রার কথা। তাগড়া যুবক। ইসলাম ভালোবাসেন। নবী ভালোবাসেন। কালেমা পড়েছেন। এই তাঁর অপরাধ। জীবনের সব বিলাসিতা মুহূর্তেই খুলে নেওয়া হয়েছে তাঁর দেহ থেকে। চাচা জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি নাকি ইসলাম গ্রহণ করেছো? দৃপ্তকণ্ঠে আবু হুরায়রা বললেন, জি। চাচা বললেন, তাহলে আমার বাড়ি ছেড়ে দাও। আবু হুরায়রা খুশি মনে বললেন, ছেড়ে দিলাম। চাচা বললেন, তোমার গায়ে যে পোশাক আছে সেটাও আমার পয়সায় কেনা। খুলে দাও। আবু হুরায়রা লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেও ইমানের আনন্দে আনন্দিত হয়ে একে একে সব পোশাক খুলে মায়ের থেকে একটি চট নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নবীজির দরবারে চলে আসেন। থাকার জায়গা নেই। খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। কাজ জুটছে না। নবীজি বললেন, তুমি আমার মসজিদে আহলে সুফফার সঙ্গে থেকে যাও। ইসলামের জন্য কী কষ্ট সয়েছেন এবার শুনুন তাঁর মুখেই। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমার জীবনে এমন অনেক দিন কেটেছে ক্ষুধার কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইত। অসহ্য ক্ষুধা নিয়ে নবীজির ঘর আর মসজিদের মিম্বরের মাঝখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতাম। মানুষ পাগল ভেবে আমার ঘাড় মাড়িয়ে চলে যেত। হে দুনিয়ার মানুষ! আমি পাগল ছিলাম না, ক্ষুধা আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেয়নি’ (বুখারি)। হজরত ফাজালা বিন উবাইদ (রা.) বলেন, রসুল (সা.) যখন লোকজন নিয়ে নামাজে দাঁড়াতেন তখন কয়েকজন মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় দাঁড়ানো থেকে হঠাৎ বসে পড়তেন। তাঁরা আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। আবারও বসে পড়তেন। তাদের অবস্থা দেখে অন্যরা বলতেন, এরা বোধহয় পাগল হয়ে গেছেন। নবীজি (সা.) ওই দুর্বল গরিব ক্ষুধার্ত সাহাবিদের দিকে ফিরে বলতেন, ‘হে আমার দরিদ্র সাহাবিরা! আল্লাহ তোমাদের ত্যাগে খুশি হয়ে তোমাদের জন্য কী চোখজুড়ানো নেয়ামত রেখেছেন যদি তা জানতে তাহলে তোমরা আরও অভাব-কষ্টের জীবন পছন্দ করতে’ (সুনানে তিরমিজি)। বুখারির আরেক বর্ণনায় আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘আহলে সুফফার অধিবাসী ছিলেন ৭০ জন। দরিদ্রতা তাঁদের এমনভাবে ঘিরে ছিল যে, শরীর ঢাকার জন্য জরুরি পোশাকটুকুও তাঁদের ছিল না। তাঁদের কারও গায়ের জামা ছিল, লুঙ্গি ছিল না। আবার কারও লুঙ্গি ছিল, গায়ের জামা ছিল না। এমনও কেউ ছিলেন জামা-লুঙ্গি কিছুই ছিল না, কোথাও থেকে একটি চাদর জোগাড় করে সেটিই ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিতেন। যাদের চাদর ছোট ছিল তারা লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার ভয়ে দুই হাত দিয়ে ঢেকে রাখতেন’। (বুখারি)। হায়! কী লিখব! কলম চলছে না। আহা! কী বলব! ভাষা পাচ্ছি না। আজ আমাদের বিলাসিতার শেষ নেই। আমাদের পোশাক-আসবাবে আলমারি ঠাসা। কিন্তু নবীর সাহাবি জান্নাতি মানুষগুলো না খেয়ে, না পরে নবীর দরবারে দীন নিয়ে পড়েছিল; তাঁদের কোনো আফসোস ছিল না। তাঁদের কোনো অভিযোগ ছিল না। আজ ছোট কোনো বিপদে পড়লেও আমাদের অভিযোগের শেষ থাকে না। আমি এত নামাজ পড়ি, এত ইবাদত করি আল্লাহ আমাকেই কেন এমন বিপদ দিলেন। অথচ ইমানের দাবিই হলো সব ধরনের মুসিবত দিয়ে আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করে জান্নাতের জন্য তৈরি করবেন। শেষ করছি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস শুনিয়ে। তিনি বলেন, ‘একদিন আমি রসুল (সা.)-এর কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি একটি পশমের চাদর গায়ে শুয়ে আছেন। জ্বরে নবীজির শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনার তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’ নবীজি বললেন, ‘নবীদের এভাবেই কঠিন বিপদে ফেলা হয় এবং প্রতিদানও দ্বিগুণ দেওয়া হয়।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর নবী! মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে কারা?’ নবীজি বললেন, ‘নবীরা।’ ‘তারপর কারা?’ ‘আলেমরা।’ ‘তারপর কারা?’ ‘সালেহিন তথা সৎ মানুষেরা। আগের যুগের ইমানদারদের এমন কঠিন দরিদ্রতা দিয়ে পরীক্ষা করা হতো যে, তাদের অনেকের গায়ে দেওয়ার মতো পোশাকও থাকত না। তাদের শরীরে উকুন-পোকা এমনভাবে বাসা বাঁধত, অনেকে এ কারণে মারা যেত। তারা বিপদে পড়লে এমন খুশি হতো তোমরা নেয়ামত পেলে যেমন খুশি হও’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
পীরসাহেব, আউলিয়ানগর