রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মায়ের হাতে সন্তান খুন গণমাধ্যম এবং র‌্যাবের অতি উৎসাহ

ফরিদা ইয়াসমিন

মায়ের হাতে সন্তান খুন গণমাধ্যম এবং র‌্যাবের অতি উৎসাহ

নুসরাত জাহান অরণি (১৪) ও আলভী আমান (৬) নামে দুই শিশুকে খুন করেছেন তাদের মা। সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের ভাষায়— ‘পৃথিবীতে এমন  মা-ও আছেন যার কাছে তার নিজের সন্তান নিরাপদ নয়।’ সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বনশ্রীর বাসায় অরণি ও আলভীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার চার দিন পরই র‌্যাব শিশু দুটির মায়ের কাছ থেকে সন্তান হত্যার স্বীকারোক্তি আদায় করে এবং সংবাদ সম্মেলন করে মা-ই সন্তানদের হত্যা করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানায়। গণমাধ্যম ফলাও করে মায়ের ছবিসহ র‌্যাবের উদ্ধৃতি দিয়ে সেই সংবাদ প্রচার করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ হত্যার ব্যাপারে মা-ই যে সন্তান হত্যা করেছে এ ব্যাপারে যতটা তত্পর অন্য ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাদের এ তত্পরতা দেখি না। র‌্যাবের সূত্র ধরে গণমাধ্যমে এই সংবাদে হত্যাকারী সম্পর্কে ফলাও প্রচার এবং তথাকথিত হত্যাকারীর ছবি প্রকাশ কতটা যুক্তিযুক্ত তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। মামলা হওয়ার আগেই বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ, স্বীকারোক্তি এবং সংবাদ সম্মেলন করে প্রচার করার আইনগত ভিত্তি নিয়ে অনেক আইনবিদই ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। মা র‌্যাব বা পুলিশের সামনে কী বলেছেন তার আইনগত ভিত্তি নেই। মামলা হওয়ার আগে এটি ফৌজদারি কার্যবিধি ও অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। র‌্যাব এও বলেছে, স্বীকারোক্তির সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন হত্যাকারী মা। তবে সাংবাদিকদের র‌্যাবের দেওয়া তথ্যই প্রকাশ করতে হয়েছে। তাদের সে তথ্য যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে কথা হচ্ছে, গণমাধ্যম এখানে কী করবে? উন্নত দেশে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। খুবই স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা অভিযুক্ত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই অপরাধীর পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। গণমাধ্যমে মায়ের ছবি দিয়ে মায়ের স্বীকারোক্তি এবং মা-ই তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন এ ধরনের শিরোনামসহ সংবাদ প্রকাশের ফলে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব কী হবে আমরা কখনো ভেবে দেখছি? যে শিশু তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে মাকে তার মনে কি সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে না যে আমার মা আমাকে খুন করবে না তো! মা-সন্তানের মধ্যে যে আস্থার সম্পর্ক সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গণমাধ্যম একটা আস্থার সংকট তৈরি করে দিচ্ছে না তো! একজন মা কেন তার সন্তানকে খুন করবেন? যিনি আদর, স্নেহ, মমতা দিয়ে সন্তানকে বড় করছেন তিনি কেন তার নিজের সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করবেন? পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন যে মা কেন পৃথিবী থেকে আবার নিজেই বিদায় করে দেবেন! অরণি ও আলভীর মা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। দুই বছর একটা কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগে পড়েছেন নিশ্চয়ই তিনি মেধাবী ছাত্রী। তার দুই চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। নিশ্চয়ই তিনি স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, নিজে কিছু করতে চেয়েছিলেন। র‌্যাবের কাছে তার স্বীকারোক্তির সময় তিনি নিজে নাকি বলেছেন, লেখাপড়া শিখে তিনি নিজে কিছু করতে পারেননি, তার ছেলেমেয়েরা কিছু করতে পারবে না এই নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। একটু গভীরে ভাবলেই বোঝা যায় তিনি জীবনে কতটা হতাশ ছিলেন। হতাশা তাকে চরমভাবে গ্রাস করেছে। সম্ভবত ক্রমে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? এই অসুস্থ সমাজ। তার পরিবার। একজন শিক্ষিত নারী এই পরিস্থিতির দিকে ক্রমে এগিয়ে গেছেন কেউ কি তা লক্ষ্য করেছে? এর পেছনে কারণ কী? এ ঘটনার আরও গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। অপরাধী চিহ্নিত করা সহজ। কিন্তু অপরাধের মূল উত্পাটন না করতে পারলে সমাজে এ ধরনের অপরাধ ঘটতেই থাকবে। পরিবারে আমরা যতটা শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ততটা ভাবী না। পরিবারে কেউ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কিনা তা-ও খেয়াল করি না। উপরন্তু তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে থাকি। অথচ মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ার কারণে সমাজে বড় বড় অপরাধ ঘটে চলেছে। তাই শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সুস্থতার বড় প্রয়োজন। একজন স্বাভাবিক মানুষ তার সন্তান খুন করতে পারে না। সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাব ক্রমে মানুষকে অস্বাভাবিক করে দিচ্ছে। সমাজে অপরাধ যুগে যুগে ছিল, থাকবে। কিন্তু শিশু খুন, মায়ের হাতে সন্তান খুন কিংবা সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন— এসব কোনো সুস্থ সমাজের চিত্র হতে পারে না। সমাজের অবক্ষয় রোধে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সচেতন হতে হবে। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের আগে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক হওয়া গণমাধ্যমের জন্য জরুরি। সামাজিক অপরাধগুলোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তড়িঘড়ি করে গণমাধ্যমকে তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে আরও ভাববার বিষয় আছে। ঘটনাগুলো যেন অন্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত না করে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবারই সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।

সর্বশেষ খবর