একসময় গল্পনির্ভর ও জীবনঘনিষ্ঠ ধারাবাহিক নাটক ছিল অমর সৃষ্টি। পঁচাত্তর থেকে নব্বই- এই সময়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট ছিল খুবই শক্তিশালী। শিল্পীদের অভিনয় ছিল মানসম্মত। ইদানীং তো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুধু গল্প দিয়ে নাটক বানানোর ট্রেন্ড চালু হয়েছে। নেই কোনো বৈচিত্র্য। এ অচলায়তন থেকে বেরিয়ে এই সময়েও কিছু জীবনঘনিষ্ঠ ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে, তবে একেবারেই কম। নাটক ইন্ডাস্ট্রির এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন - পান্থ আফজাল
এখনকার মতো বিজ্ঞাপন দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখানোর সিস্টেম তেমন ছিল না তখন। নাটক ছিল মানসম্মত। নাটক তৈরি হতো কম। কিন্তু নাটক হতো মনে রাখার মতো অভিনয়শৈলী সম্পন্ন। দর্শকপ্রিয় সেসব নাটকে ছিল তারকার সমাবেশ। কে ছিলেন না! সে সময় একটির পর একটি মন ভোলানো নাটক প্রচার হতো। মনে হতো যেন নিজের জীবনে নিজেদের পরিবারে এই ঘটনাপ্রবাহ ঘটে চলেছে। চৌদ্দ বা চব্বিশ ইঞ্চি সাদা-কালো অথবা রঙিন টিভির সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতেন সবাই। নাটক শেষ হলেও মনে তার রেশ রয়ে যেত। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখত নাটক ও তাদের প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের। সে সময় নাটকে যারাই অভিনয় করেছিলেন, পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তখনকার নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। কী সুন্দর সব নামের, গল্পের, সংলাপের ও অভিনয়ের নাটক! সোনালি সময় থেকে নব্বই-পরবর্তী সময়ও অসংখ্য সুন্দর নামের নাটক নির্মিত হয়েছে। বিটিভি চ্যানেলেই দর্শক খুঁজে ফিরেছে তাদের হাসি, কান্নাভরা মুহূর্ত। বিটিভির পাশাপাশি বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার পরও কিছু কিছু ধারাবাহিক নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেসব নাটকের তালিকা করলে প্রথমেই চলে আসে- ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকী জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘অয়োময়’ ও ‘বহুব্রীহি’, ‘শুকতারা’, ‘তথাপি’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘পারলে না রুমকী’, ‘বারো রকমের মানুষ’, ‘সময় অসময়’, ‘স্বপ্নের শহর’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘দিনরাত্রির খেলা’, ‘জব্বার আলী, ‘বেলা অবেলা’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘এখানে নোঙর’সহ বেশ কিছু নাটক দর্শকপ্রিয়তার অগ্রভাগে ছিল। আফজাল-সুবর্ণা জুটির ক্রেজ তখন তুঙ্গে। রোমান্টিক জুটি হিসেবে সার্থক। হুমায়ুন ফরীদি-সুবর্ণা, রাইসুল ইসলাম আসাদ-সুবর্ণাও বেশ নাম করেছিলেন। আরও ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, আলী আহসান সিডনী, আসাদুজ্জামান নূর, আফরোজা বানু, লুৎফুন্নাহার লতা, লাকী ইনাম, ডলি জহুর, আবুল হায়াত, আলী যাকেরসহ অনেকে। ‘সংশপ্তক’র বিটিভির ইতিহাসে জনপ্রিয়তায় ছিল শীর্ষে। এই নাটকে ফেরদৌসী মজুমদার ও হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের কথা এখনো মনে রেখেছেন অনেকে। হুমায়ুন ফরীদি এই নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে এবং ফেরদৌসী মজুমদার ‘হুরমতি’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। আজকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপি করিম ‘সকাল সন্ধ্যা’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আর ‘এই সব দিনরাত্রি’ নাটকে শিমু ভাবির চরিত্রে জনপ্রিয় হয়েছিলেন ডলি জহুর। এরপর আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ নাট্যজগতে এক বিপ্লব আনে। তখনকার নাটকের সংলাপও মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি একসময়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। পরবর্তীতে এই সব দিনরাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার- নাটকগুলোর মধ্য দিয়ে প্রচুর দর্শক তৈরি হয়েছিল। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে কতটা আপন হতে পারে তা ‘আজ রবিবার’ নাটকে আবুল খায়ের অথবা আলী যাকেরের অভিনয় প্রমাণ করে। পাশাপাশি ইমদাদুল হক মিলনের ‘রূপনগর’ নাটকে যুবরাজ খালেদ খানের সঙ্গে বিপাশা হায়াত-তৌকীর আহমেদের একচেটিয়া অভিনয় মুগ্ধতা কেড়ে নেয়। খালেদ খানের ভরাট কণ্ঠের ‘ছিঃ ছিঃ তুমি এত খারাপ’ সংলাপটি সে সময় ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উত্তরসূরিদের পথ ধরে একসময় এসেছেন জাহিদ হাসান, শহীদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকী, বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, তানিয়া আহমেদের মতো জনপ্রিয় সব তারকা। এখনো তাঁদের নিয়ে দর্শকের মাঝে অন্যরকম আগ্রহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী সময় অনেক শিল্পীই মিডিয়ায় এসেছেন। অনেক ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন বা করছেন। তবে এ প্রজন্মের প্রথম সারির নাট্যাভিনেতারা এখন ধারাবাহিক নাটকে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তারা মনোযোগ দিচ্ছেন খণ্ডনাটক ও অনলাইন কনটেন্টে-বিশেষত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নাটক বা ওয়েব সিরিজে। তারকাদের এমন মনোভাব শুধু ধারাবাহিক নাটকের প্রতি একটি সংকটই তৈরি করছে না, বরং এর ঐতিহ্য ও কনটেন্টের গুণগত মানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে। অনেক অভিনয়শিল্পীর বক্তব্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকে কাজ করে তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে সন্তুষ্ট নন। যদিও এই ক্রান্তিকালেও সালাহউদ্দিন লাভলু বেশ কিছু নাটক তৈরি করেন, যেগুলো আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে ছিল রঙের মানুষ, ভবের হাট, সাকিন সারিসুরি, দ্বিতীয়জন, হাড়কিপ্টে। এরপর ‘লাল নীল বেগুনী’, ‘চৈতা পাগল’, ‘আমাদের নুরুল হুদা’, ‘ফ্যামিলী ক্রাইসিস’ দর্শকের মাঝে মুগ্ধতা কাড়ে। কিন্তু এগুলো হাতে গোনা কিছু। এখন তো কুরুচিপূর্ণ টাইটেলের নাটকে ভরপুর চ্যানেল থেকে শুরু করে ইউটিউব। শঙ্কার বিষয়- ইউটিউব ভিউর পেছনে ছুটতে গিয়ে নাটকে বাড়ছে অশ্লীলতা। অশ্লীল সংলাপ, পোশাক ও বিভিন্ন ধরনের সুড়সুড়ি দৃশ্য দিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতা চলছে। গল্প ও শিল্পীদের চরিত্রের চেয়ে বেশির ভাগ নির্মাতার টার্গেট এখন ইউটিউব ভিউয়ার্স। আর এই ভিউয়ার্স বাড়ানো প্রতিযোগিতায় মেতে তারা যাচ্ছেতাই ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করছে। ভালো নাট্যকার নেই; নেই ভালো নির্মাতা-প্রযোজক। ভালো গল্প-স্ক্রিপ্টনির্ভর ধারাবাহিক নাটক নেই বললেই চলে এখন। অন্যদিকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অব্যবস্থাপনা ও বাজেট সংকট অনেকাংশে এই শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী। এ বিষয়ে অভিনেতা ও নির্মাতা আবুল হায়াত বলেন, ‘একসময় ধারাবাহিক নাটক পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চিত্র হয়ে উঠত। এখন শিল্পীরা অভিনয়কে পেশার চেয়ে ব্যবসা হিসেবে নিচ্ছেন। গল্পের প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। ফলে নাটকেও সেই আন্তরিকতা আর দেখা যায় না।’ মোশাররফ করিম বলেন, ‘অনলাইনের কাজের তুলনায় ধারাবাহিক নাটকে নির্মাতাদের যত্ন কম। এক দিনে ১৫-২০টি দৃশ্য ধারণ করতে হয়। গল্প গোছানো থাকে না, দ্রুত কাজ সেরে ফেলার প্রবণতা বাড়ছে।’ অপি করিম বলেন, ‘আগে ধারাবাহিকে কাজ করা সম্মানের বিষয় ছিল। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে সেই দায়বদ্ধতা নেই। অনেকে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসার জায়গা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজ বেছে নেন টাকার ভিত্তিতে।’ তবে সবাই ধারাবাহিক নাটক এড়িয়ে যাচ্ছেন না। অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ নিয়মিত ধারাবাহিকে কাজ করছেন। তাঁর মতে, ‘যারা ধারাবাহিক করছেন না, তারা জনপ্রিয়তা বা রাতারাতি তারকা হওয়ার পেছনে ছুটছেন।’ যদিও মেহজাবীনের ভিন্ন মত। তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকে নিজেকে প্রমাণের জায়গা কম, কারণ গল্পগুলো খুব সাদামাটা ও একঘেয়ে। খণ্ডনাটকে নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার সুযোগ বেশি থাকে।’ ফারহান আহমেদ জোভান জানান, ‘ধারাবাহিকে বারবার একই ধরনের চরিত্র করতে করতে একঘেয়ে লাগে। তাই খণ্ডনাটকেই মনোযোগ দিয়েছি।’ দিলারা জামান এ সময়ের ধারাবাহিক নাটক নিয়ে বলেন, ‘এখন তো তিন-চারজনকে নিয়ে নাটক বানাচ্ছেন নির্মাতারা। বাজেট স্বল্পতা দেখিয়ে নির্মাতারা দিন দিন চরিত্র কাটছাঁট করছেন। সেই পারিবারিক আবহ আর নাটকে নেই।’ অভিনেতা সজল বলেন, ‘অনেক ধারাবাহিক নাটকে চিত্রনাট্য আগেভাগে গুছিয়ে দেওয়া হয় না, শুটিংয়ের সময়ে গল্প বদলে যায়। এতে একজন অভিনেতা নিজের চরিত্রে মনোযোগ দিতে পারেন না। অনেক সময় একটি নাটক দর্শকদের পছন্দ হলে হুট করে তার পর্ব বাড়ানো হয়, যা শিল্পীদের জন্য প্রস্তুতিহীনতার ঝুঁকি তৈরি করে।’ নাট্যকার-নির্দেশক মাসুম রেজা বলেন, ‘ধারাবাহিকের যে ঐতিহ্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি। এখন ৯৮ শতাংশ নাটকেরই বিষয়বস্তু প্রেম, অপরাধ, খুন, রক্তপাত আর যৌনতার স্থূল চিত্রায়ণ। আমাদের বর্তমান নাটক দেখলে মনে হয় প্রেম ছাড়া বা প্রেমজনিত সমস্যা আর কষ্ট ছাড়া কোনো বিষয় নেই। দেশ-মাটি-মানুষের যে সংকট, রুচির যে সংকট, মানবিক সম্পর্কের সংকটগুলো আর এখন আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারছে না। আমাদের নাটক থেকে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়, বন্ধু চরিত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় কিছুসংখ্যক নায়ক-নায়িকা ছাড়া অধিকাংশ শিল্পীর হাতে কাজ নেই। উদ্বেগের সঙ্গে আশঙ্কা করছি, নাটকের ভিউ বাড়ানোর এই অসুস্থ অশ্লীল প্রতিযোগিতা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক জীবনে সুস্থ রুচি, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশের যে প্রয়োজনীয়তা, সেটাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’