বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

পঁচাত্তরে সশস্ত্র প্রতিরোধের অজানা কাহিনী

সাঈদুর রহমান রিমন

পঁচাত্তরে সশস্ত্র প্রতিরোধের অজানা কাহিনী

১৯৭৬ সালে জাতীয় মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারদের কয়েকজন ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সকাল ৮টার পরপর প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের হয় তৎকালীন বরগুনা মহকুমায়। সেখানকার মহকুমা এসডিও হিসেবে দায়িত্বে থাকা সিরাজ উদ্দীন আহমেদের সহযোগিতায় বরগুনার বাকশাল, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং গগনবিদারী আওয়াজ তুলে বিক্ষোভ মিছিল করেন। প্রায় একই সময় আমতলী, বামনা, বেতাগী, পাথরঘাটায় বাকশালের নেতা-কর্মীরা হত্যার প্রতিবাদ জানান। বেলা ১১টায় দ্বিতীয় প্রতিবাদ বিক্ষোভটি অনুষ্ঠিত হয় নেত্রকোনার হাওরবেষ্টিত উপজেলা মোহনগঞ্জে। সাবেক গণপরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আখলাকুর হোসাইনের নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক সদস্য মোহনগঞ্জে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। মিছিলটি শিয়ালজানি ব্রিজ থেকে লুহিয়ার মাঠ পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে বিক্ষুব্ধ স্লোগান ছাড়া কোনো প্রতিবাদ সভা বা বক্তব্য দেওয়া হয়নি। মিছিলে মোহনগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সেক্রেটারি আবদুল কুদ্দুস আজাদ, ছাত্রলীগ সভাপতি আক্কেব আলী, আবদুল ওহিদ, কাঞ্চন চেয়ারম্যান, মোখলেছ, স্বপন চন্দ প্রমুখ অংশ নেন। পরদিন ১৬ আগস্ট বরগুনা মহকুমার এসডিওর বাসভবনে ছোট পরিসরে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় মোহনগঞ্জের মল্লিকপুরে। চারদিকে হাওরের মাইলের পর মাইল জলরাশির মধ্যে অর্ধশতাধিক হিন্দু পরিবারের বাসস্থান মল্লিকপুর ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। পঁচাত্তরের ১৯ আগস্ট মল্লিকপুর গ্রামে হরেন্দ্র তালুকদারের বাড়ি একে একে হাজির হন ধরমপাশার সংসদ সদস্য আবদুল হেকিম চৌধুরী, গৌরীপুরের সংসদ সদস্য হাতেম আলী তালুকদার, শ্যামগঞ্জ তাত্রাকান্দা গ্রামের রজব আলী (পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), নেত্রকোনা সদরের গণপরিষদ সদস্য আব্বাছ আলী খান, সুনামগঞ্জের সাচনার কমরেড বরুণ রায়, কলমাকান্দার সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ তারা মিঞা, নেত্রকোনার আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জগদীশ চন্দ্র দত্তসহ অর্ধশতাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। খবর পেয়ে চারদিক থেকে মুজিবভক্তরা হাজির হন হরেন্দ্র তালুকদারের বাড়িতে। বিকাল ৩টার মধ্যে বিরাট আঙিনার বাড়িটিতে

তিল ধারণের উপায় ছিল না। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুজিবভক্তরা দলে দলে এসে হাজির হয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। সেদিনের কথা মনে করে পঁচাত্তরের প্রতিরোধযোদ্ধা স্বপন চন্দ আজও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা মেনে নিতে পারছিলেন না কেউ। অনেককেই কাদামাটির মধ্যে পাগলের মতো গড়াগড়ি অবস্থায় বুক চাপড়ানো আহাজারি করতে দেখা যায়। সে দৃশ্য দেখে নারী, পুরুষ, শিশু কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। একযোগে শত শত মানুষের কান্নার রোল, বুক চাপড়ানো আর্তনাদ কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। বিকাল ৪টার দিকে উপস্থিত শোকসন্তপ্ত মুজিবভক্তদের আনুষ্ঠানিক শোক ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আখলাকুর হোসাইন। সভা শেষে ডা. আখলাকুর হোসাইন অপেক্ষাকৃত যুবক ও ছাত্রদের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, মহিষখোলার ওপারে ভারত সীমান্তে জনৈকা ভানুর মায়ের বাড়িটি প্রতিবাদকারীদের আশ্রয়স্থল। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে বিপদগ্রস্ততা দেখলেই ভানুর মায়ের ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিতেও নির্দেশ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ডা. আখলাকুর হোসাইনসহ অনেকেই সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। ডা. আখলাকুর হোসাইন জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পাঁচ দিন পর বারহাট্টা থানা আক্রমণের ঘটনায় পুনরায় তাকে গ্রেফতারবরণ করতে হয়। নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতারের কারণেই প্রতিবাদ পরিণত হতে পারেনি প্রতিরোধযুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘাতকদের পক্ষে মেজর ডালিম বার বার রেডিওতে ঘোষণা করছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। অনেকেই আশা করেছিল এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হবে। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপন করেন। তৎকালীন সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধান, বিডিআরের মহাপরিচালক, পুলিশের আইজিসহ সরকারি সব বাহিনীর প্রধান গিয়ে একে একে খুনিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শীর্ষ কয়েকজন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এসব দেখে হতাশ হয়ে পড়েন সারা দেশের অগণিত মুজিবভক্ত। তবে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কিছু একটা করার জন্য তত্পর হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে তারা যোগাযোগ শুরু করেন।

২২ আগস্ট টাঙ্গইলের তৎকালীন জেলা গভর্নর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ছয়জন সঙ্গী নিয়ে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে ‘হত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে’ সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন তিনি। তার আহ্বানে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মী ভারতে গিয়ে যোগ দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। পঁচাত্তরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ বাহিনীর একটি গ্রুপ যমুনা নদী হয়ে নৌপথে প্রবেশ করে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর চরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে বগুড়া জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক খসরু নিহত হন। প্রচণ্ড যুদ্ধের মুখে তার লাশ সহযোদ্ধারা যমুনায় ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন। পরে তারা সেখান থেকে পিছু হটে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকায় চলে যান। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে পথে পথে চলে বন্দুকযুদ্ধ। এর মধ্যেই নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে, সীমিত অস্ত্রশস্ত্র রক্ষা করে প্রতিরোধযোদ্ধারা পৌঁছে যান হালুয়াঘাটের পাহাড়ি সীমান্তে।

জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন : হালুয়াঘাট সীমান্তে গিয়ে গোবড়াকুড়া গ্রামে আদিবাসী গারো প্রবোধ দিওর বাড়িতে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করা হয়। তখন থেকে দলে দলে আদিবাসী যুবকরা সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের তিন মাইল ভিতরে চান্দুভুঁই নামক স্থানে স্থাপন করা হয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার। বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। এ বাহিনীর লোগো ও ব্যাজ নির্বাচন করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ নির্বাচিত হন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এ ছাড়া ৩৬ জনকে এ বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডার করা হয়। এরা হলেন— সুনীল কুমার গুহ, ফারুক আহমেদ, আ হ সেলিম তালুকদার, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, আরিফ আহেমদ দুলাল, কবিরুল ইসলাম বেগ, সাইদুর রহমান মহারাজ, খোরশেদ আলম, আর ও মাহবুব আহমেদ, আলী হোসেন, মীর দেলোয়ার, আবদুল বাতেন, জয়নাল আবেদীন, বিজন সাহা, নাসিম ওসমান, অলোক দত্ত, দীপংকর তালুকদার, মো. আবদুল্লাহ, পংকজ আজিম, আবদুল হক, জিতেন ভৌমিক, বাবুল হক, লুত্ফর রহমান, মো. আমান উল্লাহ, তমছের আলী, আলবার্ট ম্রং, গাজী লুত্ফর, সুকুমার সরকার, হাসেমী মাসুদ জামিল, জগলুল পাশা, আবদুল হালিম, এম এ মান্নান, আবদুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, এম এ জলিল ও প্রবোধ দিও।

শুরু হলো যুদ্ধ : এ যুদ্ধ শুধু প্রতীকী যুদ্ধ ছিল না, বরং ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী অনেক বড় এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন প্রতিরোধযোদ্ধারা। সীমান্তবর্তী এলাকার পাঁচটি বিডিআর ক্যাম্প ও দুটি থানা দখল করে নিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ যোদ্ধারা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা। যুদ্ধে চার শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হাসতে হাসতে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদে। মেঘালয় সীমান্তের ভিতরে ঘন বনাঞ্চলঘেরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চান্দুভুঁইতে গড়ে ওঠে সদর দফতর। সেখানে বসে পুরোটা সময় সর্বাধিনায়কের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রধান অর্থনির্বাহী ছিলেন গারো আদিবাসী চিত্তরঞ্জন সাংমা। প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা কামারখালীর অধিবাসী আবদুল হক। একসময় সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার ভবানীপুরে। ওই এলাকা ছিল বাংলাদেশের ছিটমহল। সেখানে যেতে হলে ভারতীয় সীমানা পার হতে হতো বলে বাংলাদেশি সেনা, বিডিআর কিংবা পুলিশের কারও পক্ষে সেখানে পৌঁছা ছিল অসম্ভব। সেক্টর জিওসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন টাঙ্গাইলের সেলিম তালুকদার। সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রশান্ত কুমার সরকার। কোয়ার্টার গার্ডের অধিনায়ক ছিলেন শরীফুল ইসলাম খান আর ডিফেন্স কমান্ডার সাইদুর রহমান। হেডকোয়ার্টারের অধীনে বাংলাদেশের ভিতর বেশ কিছু সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর