দৈনন্দিন জীবনে মানুষ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া তারা চলতে পারে না। বিশেষত তাদের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আদান-প্রদানের প্রয়োজন হয়। যেমন থালা, বাটি, বটি, কাঁচির মতো প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ইত্যাদি। ইসলাম এ জাতীয় গৃহস্থালি জিনিস ধার দিতে উত্সাহিত করে।
ধার দেওয়ার বিধান
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ধার দেওয়া এবং তা থেকে উপকৃত হওয়া ইসলামী শরিয়তে বৈধ। এতে দান ও সদকার সাওয়াব পাওয়া যায়। সুযোগ থাকার পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রদান না করা নিন্দনীয়। পবিত্র কোরআনে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘(দুর্ভোগ তাদের জন্য) যারা গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় ছোট-খাটো সাহায্যদানে বিরত থাকে।’ (সুরা মাউন, আয়াত : ৭)
উল্লিখিত আয়াতের ব্য্যাখা আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এসব লোক ঠিকভাবে তাদের প্রভুর ইবাদত করে না এবং তার সৃষ্টির প্রতিও উত্তম আচরণ করে না। তারা মানুষকে এমন জিনিসও দেয় তা যার দ্বারা মানুষের উপকার ও সাহায্য করা যায়, অথচ মূল জিনিস ঠিক থাকে এবং তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এসব লোকের নিন্দা করার কারণ হলো, যারা এমন সামান্য জিনিস দিতে কুণ্ঠাবোধ করে তারা জাকাতের মতো ইবাদত থেকে আরো বেশি বিরত থাকে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১১/৬০৬)
প্রয়োজনে ধার নিয়েছেন নবীজি (সা.)
নবীজি (সা.) নিজেও নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি জিনিস ধার নিয়েছেন। আনাস (রা.)-কে বলতে শুনেছি, মদিনায় একবার শত্রুর আক্রমণের ভয় ছড়িয়ে পড়ল। নবী (সা.) তখন আবু তালহা (রা.)-এর কাছ থেকে একটি ঘোড়া ধার নিলেন এবং তাতে আরোহন করলেন। ঘোড়াটির নাম ছিল মানদুব। অতঃপর তিনি ঘোড়ায় চড়ে টহল দিয়ে ফিরে এসে বললেন, কিছুই তো দেখলাম না, তবে এই ঘোড়াটিকে আমি সমুদ্রের তরঙ্গের মতো পেয়েছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৬২৭)
এছাড়াও হুনাইন যুদ্ধের সময় সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া (রা.) থেকে নবীজি (সা.) ঢাল ধার নিয়েছিলেন। (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস : ৩৫৬২)
ফিরিয়ে দেওয়া নিন্দনীয়
সুযোগ থাকার পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় ও গৃহস্থালি জিনিস না দিয়ে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া নিন্দনীয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামাতের দিন তিন ধরনের লোকের সাথে মহান আল্লাহ কথা বলবেন না—১. যে ব্যক্তি তার কাছে রক্ষিত অতিরিক্ত পানি পথিককে দিতে অস্বীকার করে, ২. যে ব্যক্তি আসরের পর কোনো জিনিসের মূল্য নিয়ে মিথ্যা শপথ করে (কেননা শেষ বিকালে মানুষের তাড়া থাকে এবং মূল্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না), ৩. যে ব্যক্তি ইমামের কাছে বাইআত গ্রহণ করে। এরপর ইমাম তাকে পার্থিব স্বার্থ দান করলে সে তার আনুগত্য করে, আর স্বার্থ হাসিল না হলে আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করে।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২০৭)
গৃহস্থালি জিনিস দ্বারা উদ্দেশ্য
আইন গবেষক আলেমরা বলেন, গৃহস্থালি জিনিস দ্বারা এমন দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত এমন জিনিসপত্র উদ্দেশ্য যা দ্বারা উপকৃত হওয়ার পরও তার অস্তিত্ব বহাল থাকে। যেমন কুড়াল, থালা, বাটি, বটি ইত্যাদি। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। যখন তারা পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সালামের মাধ্যমে অভিনন্দন জানায় এবং আরো উত্তম বাক্যের মাধ্যমে সালামের উত্তর দেয়। তারা পরস্পরকে গৃহস্থালি জিনিস দিতে কার্পণ্য করে না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মাউন (গৃহস্থালি জিনিস দ্বারা উদ্দেশ্য) কি? তিনি বলেন, পাথর (পাথরের জিনিস), লোহা, পানি ও এই জাতীয় জিনিস।’ (ই’লাউস সুনান, হাদিস : ৫২৩১)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে ‘মাউন’-এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, যা মানুষ পরস্পরকে ধার দেয়। যেমন কুড়াল, পাতিল, বালতি ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মাউন হলো ঘরের জিনিসপত্র। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১১/৬০৬)
যা যা গৃহস্থালি পণ্যের অন্তর্ভুক্ত
ইসলাম মানুষের জীবনকে সহজ করতে এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য গৃহস্থালি জিনিস ধার দেওয়ার যে বিধান দিয়েছে, তা কোনো নির্ধারিত প্রকারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের উপকার হয় এমন যে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এর অন্তভুক্ত নয়। নিম্নোক্ত হাদিস থেকে যেমনটি বোঝা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘হে আল্লাহর নবী! কোন জিনিস থেকে বাধা দেওয়া হালাল নয়? তিনি বললেন, পানি। তিনি (প্রশ্নকারী) আবার বলে, হে আল্লাহর নবী! কোন জিনিস থেকে বাধা দেওয়া হালাল নয়? তিনি বললেন, লবণ। তিনি (প্রশ্নকারী) আবার জিজ্ঞাসা করে, হে আল্লাহর নবী! কোন জিনিস দেওয়া থেকে নিষেধ করা যায় না? তিনি বললেন, তুমি যত ভালো কাজ করবে তোমার ততই মঙ্গল হবে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৪৭৬)
ধার গ্রহণ ও প্রদানের শর্তগুলো
কোনো বস্তু ধার হিসেবে গ্রহণ করা বা প্রদান করার জন্য ফকিহ আলেমরা কিছু শর্ত আরোপ করেছেন। তা হলো—
১. ধারদাতা যোগ্য হওয়া : এর দ্বারা উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া। কেননা ধার দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের দান আছে। তাই কোনো শিশু, পাগল আর নির্বোধের ধার দেওয়া সঠিক হবে না।
২. ধারগ্রহীতা উপযুক্ত হওয়া : ধারগ্রহীতাকেও দান গ্রহণের উপযুক্ত হওয়া আবশ্যক অর্থাত্ শিশু, নির্বোধ ও পাগল না হওয়া। কেননা তারা নিজের ওপর কোনো কর্তৃত্ব রাখে না।
৩. ধারের জিনিস বৈধ হওয়া : ধার হিসেবে প্রদত্ত জিনিসের উপযোগ মুবাহ তথা বৈধ হওয়া। তাই মুসলিম দাসকে কাফেরের কাছে ধার দেয়া বৈধ হবে না। শিকারকৃত পশুকে ইহরাম অবস্থায় থাকা ব্যক্তির কাছে ধার দেওয়া বৈধ হবে না।
৪. ব্যবহারের পর অস্তিত্ব ঠিক থাকা : হিসেবে দেওয়া জিনিস এমন হওয়া আবশ্যক যা ব্যবহারের পরেও তার মূল অস্তিত্ব ঠিক থাকে।
৫. জিনিস ও তার পরিমাণ স্পষ্ট হওয়া : ধার হিসেবে দেওয়া জিনিসের প্রকৃতি, ধরন ও পরিমাণ স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। যেন ক্ষতিপূরণের প্রয়োজন হলে উভয়ের মধ্যে বিবাদ না হয়।
৬. অন্য কাউকে ধার না দেওয়া : ধার করে আনা জিনিস অন্য কাউকে ধার দেওয়া বৈধ নয়। (আল মুলাখখাসুল ফিকহি : ২/৬৩; আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, পৃষ্ঠা ৩৯২৮)
ধারের জিনিস কখন ফিরিয়ে নেওয়া যাবে
ধারদাতা ব্যক্তি ধারের বস্তু যখন ইচ্ছা তখন ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার রাখে। শর্ত হলো, এতে ধারগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারবে না। যেমন কেউ জিনিসপত্র বহন করার জন্য নৌযান ধার নিল। এখন ধারদাতা সমুদ্র বা নদীতে থাকা অবস্থায় তা ফেরত চাইতে পারবে না। (আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, পৃষ্ঠা ৩৯৪৩)
ধারের জিনিস নষ্ট হলে করণীয়
ইসলামের সাধারণ নির্দেশনা হচ্ছে, ব্যক্তি ধারের জিনিস নিজের জিনিসের চেয়ে বেশি যত্ন নেবে। কেননা এটা তার কাছে আমানতস্বরূপ। আর আমানত নিরাপদ অবস্থায় মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানতগুলোকে সেগুলোর প্রাপকদের কাছে (যথাযথভাবে) পৌঁছে দাও।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
ফকিহ আলেমরা বলেন, আমানতের জিনিস যদি পূর্ণ যত্বের সঙ্গে এমন কাজে ব্যবহার করে, সাধারণত এটা ব্যবহৃত হয়। তবে তা নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কেননা মালিকের পক্ষ থেকে এই কাজের অনুমতি ছিল। বিপরীতে যদি ভিন্ন কোনো কাজে ব্যবহার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রমাণিত হয়, তবে জরিমানা দিতে হবে। (আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, পৃষ্ঠা ৩৯৩৯)
ইমাম শাফি (রহ.)-এর মতে, ধারের জিনিস নষ্ট হলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া আবশ্যক। কেননা তা আমানত নয়, জামানত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হাতের ওপর সেই বস্তুর দায়বদ্ধতা আছে যা সে গ্রহণ করেছে; যে পর্যন্ত তা প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে না দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি)
ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে যদি মূল জিনিসের মিছিল বা অনুরূপ জিনিস সহজলভ্য হয় তবে ব্যক্তি জিনিসই প্রদান করবে। আর তা সহজলভ্য নাহলে মূল্য পরিশোধ করবে। (বুলুগুল মারাম ফি আদিল্লাতিল আহকাম, পৃষ্ঠা ১৯৫)
আল্লাহ সবাইকে আমানত রক্ষার তাওফিক দিন। আমিন।