ওয়াকফ ইসলামী শরিয়তের একটি বিশেষ দান। যার মূলকথা হলো মূল সম্পদ বহাল রেখে তা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। ওয়াকফ সাধারণ ভূসম্পত্তিই করা হয়। তবে এমন অস্থাবর সম্পদ যার স্থায়িত্ব আছে তাও ওয়াকফ করার সুযোগ আছে। যেমন বই। বই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং একই বই দ্বারা বিপুল সংখ্যক মানুষ উপকৃত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, বই দানে সকদায়ে জারিয়ার সাওয়াব মেলে। শর্ত হলো, বইটি শরিয়তের দৃষ্টিতে উপকারী বই প্রমাণিত হতে হবে।
সদকায়ে জারিয়া কাকে বলে?
সদকা অর্থ দান আর জারিয়া অর্থ চলমান। সদকায়ে জারিয়া অর্থ এমন দান যার কল্যাণ অব্যাহত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তার আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি বিষয় ছাড়া : সদকায়ে জারিয়া (যে দানের উপকার চলমান), এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৩১)। হাদিসের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, সদকায়ে জারিয়া হলো এমন দান যার উপকার বিদ্যমান থাকার কারণে তার প্রতিদানও চলমান থাকে। যেমন ওয়াকফকৃত সম্পদ।
বই দানের সাওয়াব অনন্ত
বই দানের মাধ্যমেও ব্যক্তি সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আলেমরা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার যেসব কাজ ও তার যেসব পুণ্য তার সাথে যুক্ত হয় তা হলো—যে জ্ঞান সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রচার করেছে, তার রেখে যাওয়া সত্কর্মপরায়ণ সন্তান, কোরআন যা সে ওয়ারিসি সূত্রে রেখে গেছে অথবা মসজিদ যা সে নির্মাণ করিয়েছে অথবা পথিক-মুসাফিরদের জন্য যে সরাইখানা নির্মাণ করেছে অথবা পানির নহর যা সে খনন করেছে অথবা তার জীবদ্দশায় ও সুস্থাবস্থায় তার মাল থেকে যে দান-খয়রাত করেছে তা তার মৃত্যুর পরও তার সাথে (তার আমলনামায়) যুক্ত হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২)
উল্লিখিত হাদিসের প্রথমাংশে বর্ণিত ‘যে জ্ঞানের প্রচার সে করেছে’ বাক্যটি বইয়ের জন্য প্রযোজ্য। কেননা বই দান জ্ঞান প্রচারের একটি মাধ্যম। এছাড়াও এ হাদিসে বলা হয়েছে কোরআন রেখে যাওয়া সদকায়ে জারিয়ার মাধ্যম। কেননা মানুষ কোরআন পাঠ করবে এবং তারা উপকৃত হবে। একই কারণে দানকে অনন্ত সাওয়াব লাভের মাধ্যম বলা যায়। কেননা দীর্ঘদিন যাবত মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হতে পারে।
বই দান ওয়াকফের মতোই
বই দান করা ওয়াকফের মতোই। কেননা ওয়াকফের অর্থ বই দানের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। নিম্নোক্ত হাদিসে মর্মার্থ ফুটে উঠেছে। ওমর (রা.) নবীজি (সা.)-কে বললেন, খায়বরে আমার এক শটি অংশ (জমি) আছে। এত পছন্দনীয় সম্পদ আমার কখনো ছিল না। আমি তা সদকা করার ইচ্ছা করি। নবী (সা.) বললেন, এর মূলটি রেখে তুমি এর ফল দান করে দাও। অর্থাত্ মূল জমি দান না করে জমি থেকে উত্পাদিত ফল মানুষকে দান করে দাও। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৬০৩)
বই সংরক্ষণেও মেলে সাওয়াব
বই দান করলে যেমন ওয়াকফের সাওয়াব মেলে, তেমন তা সংরক্ষণ করলেও সাওয়াব পাওয়া যাবে। যখন এই সংরক্ষণ দ্বারা উদ্দেশ্য হবে নিজের পরিবার-পরিজন, পরবর্তী প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষকে উপকৃত করা। যেমন নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাস রেখে আল্লাহর পথে সংগ্রামের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখে, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির পাল্লায় ঘোড়ার খাদ্য, পানীয়, গোবর ও পেশাব ওজন করা হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৫৩)
বই যেখানে ওয়াকফ করব
মানুষের কল্যাণের জন্য দ্বিনি বই-পুস্তক বিভিন্ন ব্যক্তি, স্থান ও প্রতিষ্ঠানে দান করা যায়। এমন কয়েকটি দানের ক্ষেত্র হলো—
১. দ্বিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : দ্বিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বই দানের একটি সুন্দর ক্ষেত্র। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত থাকেন। বাংলাদেশের মাদরাসা ও উচ্চতর ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে দুই ধরনের পাঠাগার থাকে। ক. যেখানে শুধু সিলেবাসভুক্ত বই-পুস্তক ও তার ব্যাখ্যা গ্রন্থ থাকে, খ. যেখানে সব ধরনের ইসলামী বই থাকে। এমনকি ইসলামী ধারার বাইরেও নির্বাচিত থাকে বই থাকে।
২. সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : দেশের প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠাগার আছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য পৃথক পাঠাগার থাকে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে দ্বিনি বই-পুস্তক একেবারেই অনুপস্থিত। কোনো কোনো পাঠাগারে কোরআনের কোনো অনুলিপি পর্যন্ত নেই। তাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে পরিকল্পিতভাবে দ্বিনি বই-পুস্তক দান করা যেতে পারে।
৩. মসজিদে বই দান করা : মসজিদভিত্তিক পাঠাগার মুসলিম সভ্যতার অন্যতম উত্তরাধিকার। মসজিদে নববী, দামেশকের উমাইয়া মসজিদ ও গ্রানাডার জামে মসজিদে বিশাল বিশাল পাঠাগার ছিল। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম কমপ্লেক্সে বিশাল পাঠাগার রয়েছে। মসজিদে বই দান করলে বা পাঠাগার গড়ে তুললে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হওয়ার সুযোগ পায়।
৪. গবেষণা প্রতিষ্ঠান : সরকারি ও বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান ইসলাম সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সেগুলোতেও ইসলামী বই দান করা যায়। যাতে তারা ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক ধারণা লাভ করতে পারে। বিশেষত তাদের গবেষণা সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় বিধি-বিধান সংক্রান্ত বই দান করা।
৫. গণমাধ্যম : গণমাধ্যমে ইসলাম সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে মতামত ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রায়শই এসব বিষয়ে গণমাধ্যম ভুল করে বসে। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় তাদের এসব ভুল হয়ে থাকে। তাই গণমাধ্যমগুলোতে ইসলামী বই-পুস্তক উপহার দেওয়া যায়। যেন কর্মীদেরকে ইসলামের সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে।
৬. গবেষক ব্যক্তিবর্গ : মুসলিম সমাজে এমন বহু গবেষক ব্যক্তি আছেন যারা নিরবে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক তাদেরকে উপহার দেওয়া যেতে পারে।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ