আফসানা বেগম। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই গৃহিণী ধানমন্ডি লেকে নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করতে যান। সেদিনও তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। বাসা থেকে বেরিয়ে লেকের কাছাকাছি যাওয়া মাত্র লুঙ্গি শার্ট পরা এক ব্যক্তি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সাহায্য চাইবে ভেবে আফসানা বেগম নিজের ব্যাগ খুলে ৫০ টাকার একটি নোট বের করে এগিয়ে দেন। কিন্তু লোকটি তাকে বলেন, খালাম্মা আমি ভিখিরি নই। আমি একটা কাগজ দেখাব। আমি লিখতে-পড়তে পারি না।’ লোকটিকে দেখে তার মায়া হলো। বললেন, দিন আমি পড়ে দিচ্ছি।
লোকটি হাত বাড়িয়ে আফসানা বেগমকে একটি কাগজ দেন। কাগজ খুলেই পড়তে শুরু করলেন তিনি। আফসানা বেগম লোকটির দিকে তাকায়। আবার চিঠির দিকে চোখ দেয়। চিঠিটিতে লেখা রয়েছে, ‘ভাই আসসালামুআলাইকুম, ৫ ভরির একটি স্বর্ণের বারসহ বাহককে পাঠালাম। স্বর্ণের বারটি রেখে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দেবেন। আমি এসে টাকা ফেরত দিয়ে স্বর্ণের বারটি নিয়ে আসব। এতে কোনো ভুল হবে না।’ শেষে লেখা ইতি মজিদ। চিঠিটি পড়ে অবাক হয়ে আফসানা বেগম জিজ্ঞাস করেন, ‘এটা আপনি কোথায় পেলেন? এর সঙ্গে কি কিছু ছিল?’ এ সময় লোকটি চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে। ফিস ফিস করে বলেন, হ্যাঁ, একটা সোনার মতো পাত ছিল। একথা বলেই লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা একটি স্বর্ণের বার বের করে আফসানা বেগমকে দেখায়। এতক্ষণ আফসানা বেগম ভেবেছিলেন, কোথাও কোনো গণ্ডগোল রয়েছে। কিন্তু স্বর্ণের বার দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। লোকটি তখন বলেন, ভোর বেলা এ পথেই তিনি এটি রাস্তার ওপর পেয়েছেন। এটি যে স্বর্ণের কিছু একটা হবে, তা তিনি ভেবেছিলেন। যে কারণে ভয়ে কাউকে বলতে পারছিলেন না। যদি তার নিজের কোনো ক্ষতি হয়! এমন ভেবে কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু আফসানা বেগমকে তার দেখে মনে হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই এই খালাম্মার কাছে। তাই তাকে চিঠি আর স্বর্ণের বারটি দেখান। এসব কথা শুনে আফসানা বেগম হাতে নিয়ে দেখেন স্বর্ণের বারটি। তখন লোকটি তাকে জানান, খালাম্মা, এটা আপনি সাবধানে দেখেন। পুলিশ বা অন্য কেউ যদি দেখে, তাহলে আমাদের বিপদ হতে পারে। যদি জিজ্ঞাস করে, কোথায় পেলাম, তবে আমি কী বলব? কোথাকার জিনিস এটা জানি না। এ কথা শুনে আফসানা বেগম একটু সাইডে গিয়ে স্বর্ণের বারটি উল্টেপাল্টে দেখেন। তিনি লোকটির হাতে সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, এটা একটা স্বর্ণের বার। অনেক দাম এটার। লোকটি সেটা হাতে নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তার হাত পা কাঁপছে। তিনি আফসানা বেগমকে বলেন, খালাম্মা আমি গরিব মানুষ। এটা নিয়ে আমি কোথায় যাব। কাকে দিব। পুলিশ দেখলে আমাকে ধরে নিয়ে বলবে, কোথায় পেলাম। খালাম্মা আমি জবাব দিতে পারব না। জেলে যেতে হবে আমাকে। এটা কি ধানমন্ডি লেকে ফালায়ে দিব খালাম্মা? এসব কথা শুনে আফসানা বেগম বলেন, আরে না, এটা তুমি যেহেতু পেয়েছ নিয়ে যাও। দোকানে নিয়ে বিক্রি করে দাও। তখন লোকটি তাকে বলেন, খালাম্মা বিক্রি করতে আপনি গেলে ভালো হয়। এ কথা শুনে আফসানা বেগম বলেন, আরে না, আমার সময় নেই। এটা তুমি নিয়ে যাও। তখন লোকটি বলেন, খালাম্মা এটা আমি বিক্রি করতে পারব না। তার চেয়ে এক কাজ করেন, এটা আপনি নিয়ে যান। লোকটির এমন প্রস্তাবে আরও অবাক হন আফসানা বেগম। বলে কি লোকটা? ৫ ভরি সোনার পাত আমাকে নিয়ে যেতে বলছে? এটা কি হয় নাকি? এমন সব ভাবনা করতে করতেই আফসানা বেগমের মনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
তিনি লোকটিকে জোর দিয়ে ফেরত নেওয়ার জন্য আর বলছেন না। তিনি হালকা করে বলেন, না না, আমি নিব কেন? তখন লোকটি বলেন, আমাকে কিছু টাকা দিয়েন বিবেক মতো। তাইলেই চলবে। এ সময় আফসানা বেগম ভাবতে শুরু করেন, কত টাকা দিবেন লোকটিকে। তিনি লোকটিকে বাসার কাছে নিয়ে যান। বলেন, তুমি দাঁড়াও আমি আসছি। আফসানা বেগম এ সময় ভাবছেন, বাসার কাউকে বলবেন কিনা বিষয়টি। আর এখন শহরের কোনো দোকানও খোলেনি। খুললেও হয়তো মেপে দেখা যেত। এমন সব কিছু ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি খুললেন। ভাবছেন, কারও সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার এখনই করবেন না। সংসারের খরচ আর মেয়ের সেমিস্টারের টাকা মিলে ৫০ হাজারের বেশি টাকা আছে তার কাছে। তিনি ভাবছেন, ৫০ হাজার টাকা লোকটিকে দিয়ে বিদায় করবেন। না মানলে আরও ১০ হাজার দিবেন তিনি। আফসানা বেগম কারও কাছেই কিছু বললেন না। ৫০ হাজার টাকায় তিনি দুই লাখ টাকার বেশি দামের সোনা পাচ্ছেন। সকালটা তার খুব ভালোভাবেই শুরু হলো বলে মনে করছেন আফসানা বেগম। তিনি নিচে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে লোকটিকে টাকার প্যাকেট দিয়ে বললেন, এখানে ৫০ হাজার আছে। যাও তুমি। এমন টাকার অঙ্ক শুনে লোকটির চোখে মুখে হাসির ঝলক তখন। লোকটি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। আফসানা বেগম আর মর্নিং ওয়াক করতে গেলেন না সেদিন। ভাবছেন কিছুক্ষণ পর তিনি গাউছিয়া মার্কেট যাবেন। সেখানে তার পরিচিত স্বর্ণের দোকানে বারটি নিয়ে যাবেন। যথা সময়ে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে স্বর্ণের দোকানে গিয়ে সেই পাতটি স্বর্ণকারের হাতে দিলেন। স্বর্ণকার হাতে নিয়ে বললেন, খালাম্মা এটা কী করবেন। তখন আফসানা বেগম বলেন, এটা মেপে দেখেন কত ভরি আছে। তখন লোকটি বলেন, খালাম্মা এটা তো স্বর্ণ নয়। আমি হাতে নিয়েই দেখলাম। এরপরেও পরীক্ষা করে দেখাচ্ছি। এ কথা শুনে আফসানা বেগমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি শুধু বললেন, দেখেন তো ভালো করে। পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটি ছিল পিতলের একটি পাত। আফসানা বেগম বুঝতে পারেন, তিনি বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের অভিনব পন্থায় প্রতারণা করার চক্র এখন সারা দেশে সক্রিয়। অসতর্কতার কারণে সাধারণ মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে টাকা পয়সা খুইয়েছেন। চট্টগ্রামে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে এমন প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তিনটি নকল স্বর্ণের বার, প্রতারণায় ব্যবহূত দুটি চিঠি ও সিএনজি অটোরিকশা। গ্রেফতারকৃতদের নাম মো. শাহারাজ (৩৩), মো. ইসমাইল (৩০), মো. রাশেদ (২৭) ও মো. আমিন হোসেন (৪০)। এরা চকচকে কাগজে মোড়ানো নকল স্বর্ণের পাত দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন সাধারণ মানুষকে। এরপর নকল স্বর্ণের পাতের বিনিময়ে নগদ অর্থ নিয়ে কেটে পড়েন।