পর্ব-৩
হঠাৎই রাজ্যের বিপদ টের পেয়ে বাজানো হয় রাজঘণ্টা। প্রজারা ছোটাছুটি করতে থাকে দিগি¦দিক। প্রাসাদ থেকে হেক্টর ও পিতা প্রিয়াম দেখতে পান শত শত জাহাজ ধেয়ে আসছে ট্রয়ের দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই কালো মেঘে ছেয়ে যায় গোটা সাম্রাজ্য। এদিকে গোপনে গভীর রাতে ট্রয় থেকে পালিয়ে যেতে চান হেলেন। কিন্তু ধরা পড়েন হেক্টরের হাতে। হেক্টর তাকে সাহস দেন আর বিজয় ট্রয়েরই হবে বলে আশ্বস্ত করেন। ফলে ট্রয়েই থেকে যান হেলেন। জাহাজ থেকে নেমেই যুদ্ধ শুরু করেন একিলিস ও তার সঙ্গীরা।
প্রসঙ্গান্তরে বলে রাখা দরকার যে, জাত মহাকাব্য (Authentic Epic) হোক কিংবা হোক তা সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary Epic), প্রত্যেক মহাকাব্যের সূচনা পঙ্ক্তিগুলো এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রথম পঙ্ক্তিই বলে দেয় এই মহাকাব্যের প্রধান উপজীব্য কি। যেমন ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর সূচনা পঙ্ক্তিতে বলা হয়েছে- ‘মানুষের প্রথম অবাধ্যতা এবং সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল, যার নশ্বর স্বাদ মর্ত্যে এনেছে মৃত্যু এবং আমাদের সমস্ত দুর্ভোগ।’ ‘ওডিসি’র সূচনা হয়েছে ‘বহুকৌশলী মানুষটির কথা, যিনি ট্রয়ের পবিত্র দুর্গকে ধ্বংস করার পর অনেক পথ ঘুরেছেন।’ বোঝাই যাচ্ছে, এ মহাকাব্যের উপজীব্য ইউলিসিস। দান্তের ‘দি ডিভাইন কমেডি’ সূচিত হয়েছে এভাবে- ‘আমি দেখতে পেলাম যে আমি একটি তমসাচ্ছন্ন বনের মধ্যে ছিলাম, কারণ যে পথটি সঠিক দিকে নিয়ে গিয়েছিল তা হারিয়ে গেছে।’ এই একটি বাক্যই ঈশ্বরের দিকে লেখকের যাত্রা সম্পর্কে নির্দেশ করে। ‘রামায়ণ’-এর সূচনায় ‘ঋষি বাল্মীকি নারদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, পৃথিবীতে এখনো একজন ধার্মিক মানুষ অবশিষ্ট আছে কি না, যার উত্তরে নারদ জানান যে, এই রকম একজন মানুষ হলেন রাম।’
মহাভারতের সূচনা শ্লোক ‘নারায়ণম নমস্কৃত্য নরম চৈব নরোত্তম দেবীম সরস্বতীম ব্যসাম ততো জয়ম উদিরায়েত’ এর অর্থ ‘ওম! নারায়ণ এবং নরকে প্রণাম করার পর, সর্বোত্তম পুরুষ এবং দেবী সরস্বতীকেও জয়া শব্দটি উচ্চারণ করতে হবে।’ সহজেই অনুমেয় যে, এ মহাকাব্য ঈশ্বর ও মানুষের গাথা। ‘সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি/বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে/অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি/কোন্ বীরবরেবরি সেনাপতি-পদে,/ পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি/ রাঘবারি?’ আমাদের নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে, এটি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সূচনা। সেই রীতিই অনুসৃত হয়েছে মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’-এর সূচনায়- ‘...of the wrath of Achilles...’ অর্থাৎ এ্যাকিলিসের ক্রোধ বা রোষ দিয়েই সূচিত হয় এই মহাকাব্যের কাহিনি, যা পরবর্তীতে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে মহাকাব্যিক আদলে। বলা বাহুল্য, মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র এ্যাকিলিস ওই যুদ্ধের মহানায়ক তথা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা।
এ্যাকিলিস গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র। মায়ের নাম জলদেবী থেটিস এবং পিতা ছিলেন মিরমিডনের রাজা পেলেউস। থেটিস অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। এই কারণে দেবরাজ জিউস এবং সমুদ্র, ঝড় ও ভূমিকম্পের দেবতা পোসেইডোন তাকে বিয়ে করার আগ্রহ দেখান। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী থেমিস এক ভবিষ্যৎ বাণীতে বলেন যে, থেটিসের গর্ভজাত পুত্র তার পিতার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হবেন। তাই জিউস এবং পোসেইডোন থেটিসকে বিয়ে করার ইচ্ছা ত্যাগ করেন। একই কারণে কোনো দেবতাই তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হননি। তিনি দেবতার পরিবর্তে মরণশীল মানবসন্তানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনি বিয়ে করেন পেলেয়ুস নামক এক মানবসন্তানকে। উল্লেখ্য, কোনো কোনো মতে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন প্রোমিথেয়ুস বা ক্যাল্কাস। পেলেয়ুসের সঙ্গে বিয়ের পর, তারা পেলিওন পর্বতে বিয়ে-উৎসব উদযাপন করেন এবং পেলেয়ুসের ঔরসে, তার গর্ভে এ্যাকিলিসের জন্ম হয়।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে স্ট্যাটিয়াস রচিত অ্যাকিলেইড-এর অ্যাকিলেইস খন্ডাংশ থেকে জানা যায়, এ্যাকিলিসের জন্মের পর সন্তানকে অমর করার জন্য থেটিস এ্যাকিলিসের পায়ের গোড়ালি ধরে স্টিক্স নদীতে একবার নিমজ্জিত করেন। থেটিস গোড়ালির যে অংশ ধরে ছিলেন, সেই অংশে নদীর পানি স্পর্শ না করায় গোড়ালি দৈব সুরক্ষা পায়নি। অমরত্ব লাভ করতে পারেনি কেলিস। স্টিক্স নদী হলো প্রধান পাতাল নদী যার মাধ্যমে ফেরিম্যান চ্যারন মৃতদের আত্মাকে মৃত্যুপুরি হেডিসে নিয়ে যায়। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে আন্ডারওয়ার্ল্ড ছিল যেখানে মৃতদের আত্মা বাস করতো এবং স্টিক্স নদী আন্ডারওয়ার্ল্ডের মৃতদেরকে অপর পাশের জীবিতদের থেকে আলাদা করে রাখে। এ্যাকিলিস যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন সেন্টায়ুর্সদের দলনেতা চিরোন-এর কাছে। অচিরেই তিনি গ্রিকের প্রখ্যাত বীর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ট্রয় যুদ্ধের জন্য গ্রিকরা সমবেত হতে থাকলে গ্রিকরা এ্যাকিলিসের সন্ধান করতে থাকে। কিন্তু থেটিস আগে থেকেই জানতেন যে, ট্রয়যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে এ্যাকিলিসের মৃত্যু অবধারিত। তাই তিনি এ্যাকিলিসকে রাজা লাইকোমেডেসের প্রাসাদে নারীর পোশাক পরিয়ে প্রাসাদের নারীদের ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। শেষ পর্যন্ত ওডিসিয়াস (ইউলিসিস) কৌশলে তাঁর সন্ধান পান এবং ট্রয় যুদ্ধে অংশগ্রহণে রাজি করান।
হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের শুরুতেই দেখা যায়, আকিয়ান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি আগামেনন এ্যাকিলিসকে অপমান করেন। এই কারণে এ্যাকিলিসের যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। উল্লেখ্য, আগামেনন ক্রিসেইস নামের একটি মেয়েকে ক্রীতদাসী করে রেখেছিলেন। মেয়েটির বাবা ক্রিসেস ছিলেন অ্যাপোলোর মন্দিরের পুরোহিত। তিনি আগামেননের কাছে নিজ কন্যাকে ভিক্ষা চাইলে অ্যাগামেনন তাকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করেন। এতে অ্যাপোলো ক্রুদ্ধ হয়ে গ্রিকদের মধ্যে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটান। ভবিষ্যদ্বক্তা ক্যালকাস এই দুর্বিপাকের কারণ সঠিকভাবে অনুধাবন করেন এবং পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ক্রিসেইসকে তার পিতার কাছে ফেরত পাঠানোর পরামর্শ দেন। আগামেনন রাজি হন। কিন্তু এর বিনিময়ে আদেশ করেন, এ্যাকিলিসের যুদ্ধোপহার ব্রিসেইসকে ক্রিসেইসের বদলে তাঁর কাছে পাঠাতে হবে। এতে এ্যাকিলিস অসম্মানিত-অপমানিত বোধ করেন। কারণ, এ্যাকিলিস ব্রিসেইসকে ভালোবাসতেন। সেই কারণের সঙ্গে যোগ হয় থেটিসের প্ররোচনা। এ্যাকিলিস যুদ্ধে অংশ নিতে এবং তাঁর সেনাদের অন্যান্য গ্রিক সেনাদের সঙ্গে পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।
এ্যাকিলিসের অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ গ্রিকদের বিপক্ষে চলে যেতে থাকে। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এ্যাকিলিসের যুদ্ধে যোগদান করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আগামেনন বাধ্য হয়ে ওডিসিয়াস, অন্য দুই গ্রিক প্রধান, ব্রিসেইস এবং অন্যান্য উপহার এ্যাকিলিসের কাছে পাঠান। কিন্তু এ্যাকিলিস প্রত্যাখ্যান করে জানান যে, গ্রিকদের উচিত স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা।
ট্রয় সেনাপতি হেক্টরের নেতৃত্বে ট্রোজানরা গ্রিক বাহিনীকে হটিয়ে সৈকত পর্যন্ত নিয়ে আসে। সেখানে তারা গ্রিক জাহাজগুলো লুণ্ঠন করে। এমন অবস্থাতেও এ্যাকিলিস তাঁবুতেই রয়ে যান। ধ্বংসের মুখোমুখি গ্রিক বাহিনীকে রক্ষার জন্য মিরমিডন বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন প্যাট্রোক্ল্যাশ। প্যাট্রোক্ল্যাশ ট্রোজানদের সৈকত থেকে হটিয়ে দিতে সমর্থ হন। কিন্তু ট্রয় নগরীকে যথার্থভাবে জয় করার আগেই হেক্টরের হাতে তিনি নিহত হন। প্যাট্রোক্লাস ছিলেন এ্যাকিলিসের যুদ্ধকালীন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরবর্তী কিছু প্রাচীন সূত্র দ্বারা অনুমান করা হয় যে, সে ছিল এ্যাকিলিসের প্রেমিক।
এ্যাকিলিসের প্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এ্যাকিলিস তাঁর সম্মানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করেন। এই সময় তার মা থেটিস শোকাহত এ্যাকিলিসকে সান্ত¡না দিতে এলেন। তিনি দেবতাদের কামারশালা, শিল্প-কুশলতা, উদ্ভাবন, আগুন এবং আগ্নেয়গিরির দেবতা হেফাস্টাসকে দিয়ে নতুন একটি বর্ম নির্মাণ করালেন। কারণ এ্যাকিলিসের যে বর্মটি পরে প্যাট্রোক্ল্যাস যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেটি হেক্টর নিয়ে গিয়েছিলেন। এ্যাকিলিসের বর্মের প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। এটি সভ্যতার একটি ক্ষুদ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে, যার মধ্যে জীবনের সব দিক দেখানো হয়। আইনের চিত্রায়ণ একটি শহরের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলার অস্তিত্বের নির্দেশক এবং বিবদমান সেনাবাহিনী মানবতার একটি অন্ধকার দিক চিত্রিত করে। আগ্রহী পাঠকগণ ডব্লিউ এইচ অডেন-এর অনবদ্য কবিতা ‘এ্যাকিলিসের বর্ম’ পড়ে দেখতে পারেন- যার মূল আখ্যানবস্তু হলো ‘যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন।’
প্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যুতে ক্রোধান্বিত এ্যাকিলিস মন পরিবর্তন করেন এবং যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্রোধের বশে তিনি অনেককে হত্যা করেন এবং হেক্টরকে খুঁজতে থাকেন। এমনকি এ্যাকিলিস দেব দেবীদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় জিউস স্বয়ং এ্যাকিলিসের ক্রোধে বিচলিত হয়ে ওঠেন এবং দেবতাদের পাঠিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
এথেনা তিনবার হেক্টরের প্রিয় ভাই ডেইফোবাসের ছদ্মবেশে হেক্টরকে এ্যাকিলিসের সঙ্গে সম্মুখসমরে যেতে নিষেধ করেন। এ্যাকিলিস ট্রয়ের প্রাচীরের চারিধারে তিনবার হেক্টরকে ধাওয়া করেন। শেষপর্যন্ত হেক্টর যুদ্ধক্ষেত্রে এ্যাকিলিসের মুখোমুখি হন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১২তম দিনের যুদ্ধে এ্যাকিলিস হেক্টরকে বধ করেন। এরপর হেক্টরের দেহ নিজের রথের সঙ্গে বেঁধে নয় দিন ধরে যুদ্ধক্ষেত্রময় তা হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ান।
হেক্টর ছিলেন ট্রয়ের যুবরাজ এবং মহাযোদ্ধা। তিনি রাজা প্রিয়াম এবং রানি হেকুবার প্রথমজাত পুত্র। তাকে একজন সুযোগ্য রাজপুত্র এবং তার পিতার সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। হেক্টর অ্যান্ড্রোমাচির সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি ছিলেন তার স্ত্রী এবং তার প্রথম এবং একমাত্র শিশু পুত্র স্ক্যামান্ড্রিয়াসের মা, যাকে ট্রয়ের লোকেরা আস্তিয়ানাক্স নামে চিনতো।
পুরো ট্রয়যুদ্ধ জুড়ে হেক্টর ট্রয়বাসীর জন্য গৌরব বয়ে এনেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন তাদের সেরা যোদ্ধা এবং উত্তরাধিকারী। তিনি রাজ্যের সব লোকদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় এবং কখনো লড়াইকে প্রত্যাখ্যান না করার জন্য পরিচিত ছিলেন। সবার প্রতি ছিলেন দয়াবান। সেরা যোদ্ধা ছিলেন বিধায় গ্রিকরা তাকে ঘৃণা ও ভয় করতেন। তিনি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন, তাদের বাধার প্রাচীর ভেঙে দিলেন এবং তাদের সৈন্যদের হত্যা করলেন। যদিও তিনি প্যাট্রোক্লাসকে হত্যা করার পর এ্যাকিলিস পুনরায় যুদ্ধে প্রবেশ করেন এবং ট্রোজানরা তাতে নাস্তানাবুদ হয়ে যায়।
এ্যাকিলিসের দ্বারা একক যুদ্ধে হেক্টর নিহত হন। হেক্টরের বাবা-মা ট্রয়ের দেয়ালে বসেছিলেন, তাকে নিরাপদ দেয়ালের মধ্যে আশ্রয় নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। হেক্টর তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ্যাকিলিসের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, রক্তপাত ছাড়াই বিবাদের সমাধান করার প্রয়াসে। কিন্তু এ্যাকিলিস তার ঘনিষ্ঠ যুদ্ধকালীন সঙ্গী প্যাট্রোক্লাসকে হত্যা করার কারণে যুক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন।
এ্যাকিলিস তিনবার ট্রয়ের মূল ফটকের চারপাশে হেক্টরকে তাড়া করেন। অ্যাপোলো হেক্টরকে শক্তি দিয়েছিল, যাতে সে সবসময় নেতৃত্বে থাকতে পারে। এথেনা তার প্রিয় ভাই ডেইফোবাসের ছদ্মবেশ নিয়ে তাকে বলেছিলেন যে, তারা একসঙ্গে এ্যাকিলিসের মুখোমুখি হতে পারে। তার জেতার সুযোগ থাকতে পারে ভেবে প্রতারিত হয়ে, হেক্টর এ্যাকিলিসের জন্য অপেক্ষা করেন। তারপর তিনি প্রস্তাব করেন যে, যে কেউ জিতবে, সে অন্যের দেহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং লাশ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেবে যাতে তারা যথাযথভাবে তাকে সমাধিস্থ করতে পারে। এ্যাকিলিস এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, ‘আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। অন্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি নেই’। একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর, এ্যাকিলিস হেক্টরকে তার গলায় ছুরিকাঘাত করে। যার ফলে তার অকাল কিন্তু ভাগ্যবান মৃত্যু ঘটে। হেক্টর তখন এ্যাকিলিসের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন যে, প্যারিস এবং অ্যাপোলো তাকে হত্যা করবে।
হেক্টরবধের পর এ্যাকিলিস হেক্টরের বর্ম খুলে ফেলেন। তখন অন্য গ্রিকরা হেক্টরের দেহ দেখতে এবং ছুরিকাঘাত করতে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এ্যাকিলিস বিজয়সূচক একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে মৃত হেক্টরের গোড়ালিতে কাছি পেঁচিয়ে তার রথের সঙ্গে বেঁধে নেন। তাকে ট্রয় শহরের চারপাশে টেনে নিয়ে যান। ট্রোজানরা তখন ব্যস্ত তাদের দেয়ালের নিরাপত্তায়।
চলছে আকাশ-বাতাস কম্পিত করা বিলাপ-রোদন বিশেষ করে হেক্টরের স্ত্রীর আহাজারিতে যেন কেঁপে উঠছে পুরো অমরাপুরি। কিন্তু এ্যাকিলিস যা করেছিল, তা ছিল একজন বীরযোদ্ধার পক্ষে বড়ই অসম্মান আর অমর্যাদার; পরে যা তার ওপর দেবতাদের ক্রোধ বয়ে আনে।
প্যাট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলাকালীন এবং এর পরেও এ্যাকিলিস তার চিতার চারপাশে হেক্টরের দেহ টেনে নিয়ে যান। দেবতা আফ্রোদিতি এবং অ্যাপোলো তার দেহকে কুকুরের আক্রমণ, বিকৃতকরণ এবং পচন থেকে রক্ষা করেছিলেন। প্রিয়াম হেক্টরের দেহের জন্য মুক্তিপণ নিয়ে এ্যাকিলিসের কাছে যাওয়া পর্যন্ত আরও ১২ দিন অতিবাহিত হলো। প্রিয়াম তাঁর বীর পুত্রের মরদেহের বীরোচিত শেষকৃত্তের জন্য হেক্টরের মরদেহ ফেরত চেয়ে এ্যাকিলিসের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন। সে দৃশ্য-যে কতোটা লজ্জার, কতো অসম্মানের আর কতোটা গ্লানিকর ছিল, তা রাজা প্রিয়ামের জবানিতেই শুনুন, “ আমি সহ্য করেছি যা, পৃথিবীতে এর আগে কেউ কখনো করেনি- আমি আমার এই ঠোঁট দিয়ে সেই ব্যক্তির হাত চুম্বন করেছি, যে আমারই মহাবীর পুত্রের ঘাতক।”
প্রিয়ামের সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর এ্যাকিলিস আমাজনীয় যুদ্ধনায়িকা পেন্থেসিলিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। প্রথমে পেন্থেসিলিয়ার রূপে মুগ্ধ এ্যাকিলিস তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি। পরে তিনি বুঝতে পারেন পেন্থেসিলিয়ার রণকৌশল তাঁর অপেক্ষাও উন্নত এবং তার প্রতি আকর্ষণ এ্যাকিলিসের কাছে মারাত্মক হতে পারে। এই কারণে তিনি যুদ্ধ করেন ও পেন্থেসিলিয়াকে হত্যা করেন। কিন্তু এমন সুন্দরী নারীকে হত্যা করে তিনি শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং বিলাপ করতে থাকেন।
প্রথম যুদ্ধেই ট্রয় নগরীর বন্দর দখল করেন নেয় গ্রিকরা। এভাবে টানা ১০ বছর বন্দর ও রাজ্য অবরোধ করে রাখে গ্রিকরা। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে নিহত হয় একিলিসের ভাই উইরোরাস, প্যারিসের বড় ভাই ট্রয় বীর হেক্টর ও নাম না জানা উভয়পক্ষের হাজারো যোদ্ধা। যুদ্ধে সহজে জয়লাভ না করতে পেরে শেষপর্যন্ত প্রতারণার আশ্রয় নেয় স্পার্টানরা। তৈরি করে বিশালাকৃতির অদ্ভুত এক ঘোড়া। যা ইতিহাসে জঘন্যতম প্রতারণার প্রতীক হয়ে আছে। ঘোড়াটি ‘ট্রোজান হর্স’ নামেই খ্যাত। আর এই ঘোড়াতেই লুকিয়ে ছিল ট্রয়ের লজ্জাজনক পরাজয়। সেই প্রবঞ্চনা থেকেই ট্রয়যুদ্ধের শেষ ট্র্যাজিক পরিণতি।
ইউলিসিসের পরামর্শে এই বিরাট আকৃতির ঘোড়াটি তিন দিনে তৈরি করেছিলেন এপিয়াস নামের এক সুদক্ষ ছুতার। ওডিসিয়ুস (ইউলিসিস)-এর পরিকল্পনামতে ঘোড়াটি ফেলে রেখে গ্রিকরা পালিয়ে যাবার ভান করে জাহাজে করে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। বিশাল আকারের এই ঘোড়ার ভেতরে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত অর্ধশত সাহসী যোদ্ধার এক বহর সন্তর্পণে লুকিয়ে থাকে। গ্রিকদের একজনকে পেছনে রেখে যাওয়া হয়, যে কিনা ট্রয়বাসীদের বোঝাবে যে, ঘোড়াটি তাদের অপরাজয়ের স্মারক হিসেবে উপহার দেওয়া হয়েছে এবং তা দেবী এথিনার উদ্দেশ্যে নিবেদিত অর্ঘ্য। ঘোড়ার গায়ে খোদাই করে লেখা হয় "For their return home, the Greeks dedicate this offering to Athena" এরপর গ্রিকরা তাদের তাঁবুগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে এবং নিকটবর্তী টেনিডোস দ্বীপে রাতের আঁধারে লুকিয়ে যায়।
[চলবে]