দেশে উৎপাদিত চিনির তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। তাই বাড়ছে চিনির দামও। আর চিনির চাহিদা পূরণে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে স্টিভিয়া চাষ করছেন জীবন কৃষ্ণ রায় নামে এক যুবক। ইতোমধ্যে তিনি সফলও হয়েছেন। স্টেভিয়া মিষ্টি গুল্ম জাতীয় ভেষজ গাছ। স্টিভিয়ার পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০-৪০ গুণ এবং পাতার স্টিভিয়াসাইড চিনি অপেক্ষা ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। চিনির বিকল্প হিসেবে জিরো ক্যালরি স্টিভিয়ার পাতা ব্যবহার করা যায়।
জানা গেছে, বহির্বিশ্বের অনেক দেশে চিনির বিকল্প হিসেবে স্টিভিয়া চাষাবাদ হচ্ছে। প্রতি কেজি স্টিভিয়ার পাউডার ৩০-৩৫ কেজি চিনির কাজ করবে। ডায়াবেটিস রোগীদের সমস্যা বাড়ায় চিনি। কিন্তু এটিতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। পরীক্ষামূলকভাবে স্টিভিয়া চাষ করে সফল হয়েছেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জীবন কৃষ্ণ রায়। মাত্র ১৭টি স্টিভিয়া চারা থেকে প্রকল্প শুরুর আট মাসেই শতাধিক চারা হয়েছে তার বাগানে। এখন পরিকল্পনা বাণিজ্যিকভাবে চাষের।
জীবন কৃষ্ণ রায় কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের সোনারহাট এলাকার ভূপেন্দ্রনাথ রায়ের ছেলে। জীবন কৃষ্ণ রায় আদিতমারী উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। চাকরির ফাঁকে ছুটির দিনে স্টিভিয়া বাগান পরিচর্যা করেন তিনি।
তিনি জানান, চাকরি জীবনের এক প্রশিক্ষণে গিয়ে স্টিভিয়া সম্পর্কে আলোচনা শোনেন। তখন বাড়িতে স্টিভিয়ার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর ইউটিউবে দেখে অনলাইনে অর্ডার করে পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন থেকে ১৭টি চারা সংগ্রহ করে বাগানে রোপণ করেন। মাত্র আট মাসের ব্যবধানে তার বাগানে ২০০ চারার অধিক হয়েছে।
জীবন কৃষ্ণ বলেন, গাছে গোড়া থেকে গজিয়ে ওঠা নতুন গাছ থেকে স্টিভিয়ার চারা সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটি গাছে মাত্র তিন মাসে পাতা ও ডাল সংগ্রহ করা হয়। এরপর এসব পাতা ও ডাল রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করতে হয়। সেই গুঁড়া সামান্য পরিমাণ পানিতে দিলে তা চিনির চেয়েও বেশি মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। পাঁচ/সাতটি কাঁচা পাতা পানিতে দিয়ে গরম করলে চিনির মতো মিষ্টি হবে, এতে এক কাপ চা তৈরি করে খাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, চা পানেও স্টিভিয়ার কাঁচাপাতা ব্যবহার করা হয়। কাঁচা পাতা পানিতে দিয়ে গরম করে চা-পাতা দিলে স্বাদ পাওয়া যাবে। যারা চিনি ছাড়া চা পান করেন, তাদের জন্য স্টিভিয়ার কাঁচাপাতা বা গুঁড়া দিলেই চিনি ছাড়াই চিনির স্বাদ পাবে। স্টিভিয়ার গুঁড়া দিয়ে ফিরনি-পায়েস তৈরি করা সম্ভব। স্টিভিয়ার প্রতি কেজি গুঁড়া ৩০-৩৫ কেজি চিনির কাজ করে। স্টিভিয়ার গুঁড়া বাজারজাত করা যায়। যা বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকা দরে। জীবন কৃষ্ণ বলেন, ‘বাগানে উৎপাদিত স্টিভিয়ার গুঁড়া রংপুর ডায়াবেটিস সমিতিতে রোগীদের জন্য পাঠানো হয়। রোগীরা এর চা পান করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে সফল হয়েছেন। এখন ডায়াবেটিস রোগীরা আমার বাগানের স্টিভিয়ার চাহিদা প্রকাশ করেছেন। তাদের চাহিদা বিবেচনায় বাগানের পাতা ও ডাল সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে তা ব্লেন্ডার মেশিনে গুঁড়ো করে সরবরাহ করছি। এই প্রজেক্টটি পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ে বেশ সফল হয়ে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের পরিকল্পনা নিয়েছি। স্থানীয়রা অনেকেই দেখতে আসেন, বাগান থেকে চারা সংগ্রহ করেন। গত কিছু দিন আগে অতি বৃষ্টির কারণে অনেক চারা মরে গেছে। এটি বাড়ির বারান্দায় টবেও চাষাবাদ করা যায়। সেই চাহিদা বিবেচনায় টবে চারা তৈরি করা হয়েছে। স্টিভিয়ার পাতা মুখে চিবিয়ে খেলে মুখে মিষ্টির স্বাদ দীর্ঘ সময় থেকে যায়। শিশুরা এ গাছকে চকলেট গাছ, কেউ চিনি গাছ আবার কেউ এটিকে মধু গাছ বলেও চিনে। স্থানীয় ভবেষ রায় বলেন, ‘স্টিভিয়ার পাতা চিনির চেয়েও মিষ্টি শুনে জীবন কৃষ্ণ দাদার বাগানে এসেছি বাস্তবে দেখতে। সত্যিই চিনির বিকল্প এটি। আমি খেয়ে দেখে একটি চারা সংগ্রহ করেছি বাড়িতে লাগাব। এটি আমাদের চিনির চাপ কমাতে সাহায্য করবে।’ কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল কাদির গণি বলেন, স্টিভিয়ার পাতা মিষ্টির স্বাদ মিললেও তা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সেবনযোগ্য। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা স্টিভিয়া ব্যবহার করে থাকেন। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাইখুল আরেফীন বলেন, ‘স্টিভিয়া চিনির বিকল্প একটি ফসল। এর ব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। এটি বর্তমানে অনলাইনে কেনাবেচা হচ্ছে। সঠিক প্রক্রিয়ায় বাজারজাত করতে পারলে এর চাহিদা বাড়বে। স্টিভিয়া মিষ্টি হলেও ডায়াবেটিসের কোনো ক্ষতি করে না। এর চাষাবাদ বাড়লে চিনির ঘাটতি পূরণে বেশ সহায়ক হবে।