রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে চলছে দুই ছাত্রলীগ নেতার সাম্রাজ্য। হল থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয়া, সিট বাণিজ্য, অকারণেই শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে হলটিকে নিজেদের সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলেছেন তারা। এই দুই ছাত্রলীগ নেতার অপকর্মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের গত দুই বছরে অর্জিত সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রলীগ নেতার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে শিক্ষার্থীদের সিট দিয়ে এই দুই ছাত্রলীগ নেতা প্রতি সিট বাবদ দুই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। যে শিক্ষার্থী এই নিদিষ্ট পরিমান টাকা দিতে ব্যর্থ হয় কিংবা তাদের শরণাপন্ন না হয়ে হলে উঠে তাকে হল থেকে বের করে দিচ্ছেন। ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- ছাত্রলীগ নেতার শরণাপন্ন না হয়ে হলে উঠলে বের করে দেওয়া হয়। হল প্রশাসন কর্তৃক কক্ষ বরাদ্দ পেলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের না জানিয়ে হলে উঠা যায় না। আবার হলে উঠার বিষয়টি তাদের জানালেও একটি নিদিষ্ট পরিমান টাকা তারা দাবি করে। আর এ টাকা দিতে না চাইলে হল থেকে বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন হুমকি দেন। এছাড়াও ছাত্রলীগ নেতারা হলের প্রত্যেক সাধারণ শিক্ষার্থীর কক্ষে গিয়ে কোন শিক্ষার্থীর মাস্টার্স কবে শেষ হবে এবং কখন হল ছেড়ে চলে যাবেন সেই তথ্যও সংগ্রহ করতে ব্যস্ত থাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হলের চার সিটের কক্ষে একটি সিট পেত হলে দুই হাজার টাকা, দুই সিটের কক্ষ আড়াই হাজার টাকা এবং সিঙ্গেল সিটের কক্ষ পেতে হলে শিক্ষার্থীকে তিন হাজার করে ছাত্রলীগে নেতাদের দিতে হয়। তবে মাঝে মাঝে এই টাকার বেশি টাকা দিয়েও হলে সিট পেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া সিট বাণিজ্যের সুবিধার্থে হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিয়মিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে কখন কোন শির্ক্ষার্থীর মাস্টার্স শেষ হবে এবং সেই শিক্ষার্থী কবে হল ছাড়বেন সেসব তথ্য সংগ্রহ করেন বলেও জানা যায়। আর এসব কর্মকান্ডের নেপথ্যে রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এসএম রুহুল আমিন ও মাহমুদুল হাসান শাকিল।
হল সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক মাসে শাকিল ও রুহুল হলে আবাসিকতা পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের হওয়ার জন্য চাপ দেয় এবং বের না হলে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন। এদের মধ্যে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে তার কক্ষ থেকে বের করে দেয় শাকিল ও তার কর্মীরা। পরে ওই শিক্ষার্থী তার পরিচিত কয়েজন বড় ভাইকে জানালে শাকিল তাকে ডেকে নিয়ে হুমকি দেন। পরে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী ভয়ে হল ছেড়ে চলে যান। এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা রুহুল গত জুলাইয়ে অন্য আরেক শিক্ষার্থীর কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে নেন এবং ওই শিক্ষার্থীকে হলের অন্য একটি কক্ষে উঠতে বলেন।
সর্বশেষ গত এক সপ্তাহ আগে হলের ৩৫০ নম্বর কক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া বিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দুই আবাসিক শিক্ষার্থীকে হল থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেন শাকিল। পরে ওই দুই শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষকে বিষয়টি জানালে প্রাধ্যক্ষ তাদেরকে হলে থাকার নির্দেশ দেন। এরপর শাকিল আবারও ওই শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে হল থেকে কেন এখনো বের হয়নি তা জানতে চান। পরে ওই শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষের কথা বললেও তাকে দ্রুত হল ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এদের মধ্যে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী হলের সিট ছেড়ে দিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এক মেসে অবস্থান করছেন।
ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা দিয়ে হলে উঠার প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে আবাসিকতা পেয়ে থাকলেও হলে সিট পাচ্ছিলাম না। পরে হলের এক ছাত্রলীগ নেতাকে তিন হাজার টাকা দিলে আমাকে সিটের ব্যবস্থা করে দেন। তবে ওই শিক্ষার্থী ভয়ে ছাত্রলীগ নেতার নাম বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ফোর বেড থেকে সিঙ্গেল রুমে যাবো। সেজন্য রুহুল ভাই আমার কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা দাবি করে পরে তাকে সে টাকা দিলে আমাকে সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা করে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, গত আগস্ট মাসে আমি হলের দ্বিতীয় ব্লকের ২৭৬ নম্বর কক্ষে উঠি। পরে সেখানে ছাত্রলীগ নেতা এসএম রুহুল আমিন এসে আমার বেড নামিয়ে দেয় এবং আমাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে বলে। পরে আমি বিষয়টি হলের কয়েকজন বড় ভাইকে জানালে তারা গিয়ে বিষয়টি সমাধান করে।
ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, হলের ৪৪৮ নম্বর কক্ষে আমি উঠি। পরে ছাত্রলীগের এক নেতা গিয়ে আমার হল থেকে চলে যেতে বলে এবং আমার সিটে অন্য একজনকে উঠিয়ে দেয়। পরে বিষয়টি হলের এক সাংবাদিক বড় ভাইকে জানালে তিনি এসে সমাধান করেন।
ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ক্যাম্পাসে এসে প্রথমে রাজনীতি করি। পরে আমার পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে আর রাজনীতি করা হয়নি। এরপর আমি হলের ১৩১ নম্বর কক্ষে উঠি। সেখানে গিয়ে শাকিল আমাকে রাতের মধ্যে হল থেকে চলে যেতে বলে। আর না গেলে আমাকে দেখে নেবেন বলেও হুমকি দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সুপারিশে আমি এখন হলে অবস্থান করছি।
এদিকে হলের সিট বাণিজ্য ও অবৈধভাবে সিট দখল করার বিষয়টি শাকিল ও রুহুল আমিন অস্বীকার করেন। তারা বলেন, ‘সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে তাই একটি কুচক্রী মহল আমাদের নামে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। আমরা কখনো এ ধরণের কাজ করিনি।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা কোন শিক্ষার্থীকে বের করে দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের কাছে কেউ কোন অভিযোগও করেনি। আর যদি কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে আমরা খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।’
এ বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। কিছুদিন হলো আমি হলে প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। আমার কাছে যদি কেউ সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে হল প্রশাসন ও হলের আবাসিক শিক্ষকদের নিয়ে খোঁজ খবর নিবো এবং কারও বিরুদ্ধে এ রকম প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/৭ অক্টোবর ২০১৮/হিমেল