২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তার আর স্বামী জুয়েলকে নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯)। তবে হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন হল। স্বামী ছেড়ে শিশু সন্তান রোজাকে নিয়ে ৩১ মার্চ বাসা থেকে বের হয়ে যায় মিতু। এরপরই টনক নড়ে বাবা নুরুল ইসলাম আর তার মেয়ের জামাতা জুয়েলের। র্যাবের কাছে অভিযোগ দেন তারা। তদন্তে নামে র্যাব। সবশেষ মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া ৭ টায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দা কেল্লা এলাকা থেকে মিতুসহ তিনজনকে গ্রেঠতার করা হয়। এসময় জঙ্গিবাদী লিফলেট ও বই উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হল- জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯), মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২) ও আকবর হোসেন ওরফে সুমন (৩০)। আজ বুধবার দুপুর ১২ টায় প্রেস ব্রিফিং করে এসব তথ্য জানান, র্যাব ১১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্ণেল কামরুল হাসান (পিপিএম)।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে অবস্থিত র্যাব ১১ সদর দপ্তরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাব ১১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্ণেল কামরুল হাসান (পিপিএম) জানান, গত ২ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও নিবাসী মো. নুরুল ইসলাম তার মেয়ে এবং তার জামাতা জুয়েল র্যাব-১১ কার্যালয়ে এসে লিখিত একটি অভিযোগ দায়ের করে। ঐ অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, তার মেয়ে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯) জঙ্গী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তার ২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারকে নিয়ে ৩১ মার্চ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। দ্রুত তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য তারা অনুরোধ জানালে র্যাব ১১ সদস্যরা গোয়েন্দা নজরদারী করে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে একাধিক অভিযান পরিচালনা করে। একপর্যায়ে র্যাব সদস্যরা ১৭ এপ্রিল (মঙ্গলবার) সোয়া ৭ টায় নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন সোনাকান্দা কেল্লা এলাকা থেকে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯) এবং তার দুই সহযোগী মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২), এবং আকবর হোসেন সুমনকে (৩০) গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই, লিফলেট ও মিতু’র ২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারকেও উদ্ধার করে।
র্যাবের সিও জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু তাদেরকে জানায় যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ফেইসবুক আইডি ‘আল্লাহর সৈনিক’ এর মাধ্যমে জনৈক মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদের সাথে তার পরিচয় হয়। মেহেদী তাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কাজ করার আহবান জানিয়ে জেএমবি নেতা জসিম উদ্দিন রাহমানির উগ্রবাদী বক্তব্য সম্বলিত বিভিন্ন বক্তব্য সরবরাহ করে। এ প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হলে তাকে জেএমবির দাওয়াত দেয়। এছাড়াও নামাজ আদায় না করলে ও দাঁড়ি না রাখলে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করা উচিত বলে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদান করে। মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ তাকে বাংলাদেশ সরকার ও ত্বাগুত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হওয়ার আহবান জানালে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু তাতে সাড়া দেয়।
এরপর থেকে মিতু তার ফেইসবুক আইডি ‘‘এসো ইসলামের পথে’’ এবং ‘‘আলোর পথ ইসলাম’’ থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র এবং ভিডিও সহ বিভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকে। সে তার কাছের বন্ধু-বান্ধবদের কথিত জিহাদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করে। জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু তার স্বামী জুয়েলকে উগ্রবাদের পথে আসার আহবান জানিয়ে ব্যর্থ হলে স্বামীকে ত্যাগ করে কথিত শহীদি মৃত্যু বরণ করার লক্ষ্যে হিযরত করার পরিকল্পনা করে। তার পরিকল্পনার কথা মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদকে জানালে সে তাকে মাহরাম ছাড়া হিযরত করা যাবেনা বলে জানায় এবং তার বন্ধু আকবর হোসেন সুমনকে মাহরাম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়।
এরপর মেহেদী তার বন্ধু আকবর হোসেন ওরফে সুমনের সাথে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সুমনকে মাহরাম হিসেবে পাওয়ার জন্য জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুু তার স্বামী জুয়েলকে ডির্ভোস দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সুমন ও মেহেদীর পরামর্শ অনুযায়ী জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু গত ৩১ মার্চ সোনারগাঁয়ের তার নিজ বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে যায়। সুমন ও মেহেদী তাকে সেখানে একটি ভাড়া বাসা ঠিক করে দেয়। তারা দুজনে জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুকে শহীদ হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করে এবং জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতুুকে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। পরে তারা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার কয়েকজন জেএমবি সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা নেয়। এ লক্ষেই তারা নারায়ণগঞ্জের বন্দরে একত্রিত হয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
মিতু ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়র মেঘনা শিল্পনগরী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করে এ কলেজেই এইচএসসিতে অধ্যয়নরত। গ্রেফতার হওয়া মোঃ মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২) ২০০৫ সালে আমিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রাউজান, চট্টগ্রাম হতে ৫ম শ্রেণি পাশ করে। পরবর্তীতে ফটিকছড়ি মাইজভান্ডার হেফজখানাতে ৩/৪ বৎসর পড়ালেখা করে। সে ২০১১ সাল হতে চট্টগ্রামের হালিশহর ও ইপিজেড এলাকায় একটি ফুড প্রোডাক্টস্ কোম্পানীতে সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে চাকুরী করার পর ২০১৫ সালে সে জনৈক সামি ভাই এর মাধ্যমে হানাফি থেকে সালাফি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়। এরপর সামি ভাই তাকে উগ্রবাদী বিভিন্ন বয়ান শুনে ও কিছু বই পড়ে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন সালাফি মসজিদে যাতায়াত শুরু করে।
২০১৫ সালের শেষদিকে সামি তাকে অপর এক দ্বীনি ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মেহেদী দাওয়াতী কাজে ব্যাপকভাবে তৎপর ছিল। এসময়ে সে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জেএমবির কর্মী সংগ্রহ করেছে। ২০১৮ সালে সে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে সফর করে বিভিন্ন গোপন মিটিং ও জেএমবির কর্মী সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সে বিভিন্ন সময়ে দ্বীনি বোনদেরকে পর্দার আড়াল থেকে জেএমবির আদর্শিক বয়ান প্রদান করত এবং বাংলার মাটিতে জিহাদ কায়েম করার জন্য একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাত। এর সুবাদে একাধিকবার মিতুর সাথে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মেহেদীর দেখা হয়। মেহেদী সরাসরি দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করত।
গ্রেফতার হওয়া অপর জেএমবি সদস্য আকবর হোসেন ওরফে সুমন (৩০) ২০০৩ সালে নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার চর আমান উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিল। ২০০৭ সাল সে চট্টগ্রামের হালিশহরে একটি বেকারীর সেলসম্যান হিসেবে চাকুরী করে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে অপর একটি ফুড প্রোডাক্টস কোম্পানীর সেলস্ ম্যানেজার মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদের সাথে তার পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের মাধ্যমে মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ, উগ্রবাদের দাওয়াত দেয় সুমনকে। পরবর্তীতে তাকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই পড়তে ও উগ্রবাদী বয়ান শুনানোর মাদ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা দেয়।
ফলে ধীরে ধীরে সুমন জেএমবির সাথে জড়িয়ে পড়ে বলে উল্লেখ করে র্যাবের সিও। এরপর সুমন এবং মেহেদী একত্রে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের কাজ করে। সে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের উস্কানীমূলক বক্তব্য ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করে সকলকে জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করাসহ নিজেকে আত্মঘাতি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে বলে জানায় র্যাব সিও।
মেহেদীর মাধ্যমে মিতুর সাথে সুমনের পরিচয় হয়। সুমন মিতুকে হিযরত করে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন প্রকার অপব্যাখ্যা প্রদান করে। সে এ পর্যন্ত ১০-১২ জনকে জেএমবির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু হিযরত করে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর সে ও মেহেদী হাসান মাসুদ মিলে মিতুকে বাসা ভাড়া করে দেয়। পরবর্তীতে সুমন ও মেহেদী মিতুকে নিয়ে কর্মী সংগ্রহ করাসহ পরিচিত জেএমবি সদস্যদেরকে হিযরতে আহবান করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা করে নারায়ণগঞ্জে আগমন করে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে উল্লেখ করে র্যাব।
বিডি প্রতিদিন/১৮ এপ্রিল ২০৮/হিমেল