বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় দণ্ডিত পলাতক আসামি সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া আবারও আলোচনায়। জিয়া এবং আকরাম হোসেনকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করায় বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে সরকারের উচ্চপর্যায়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, জিয়া বাংলাদেশেই রয়েছে। তবে তারা দেশে না বিদেশে পলাতক, জীবিত নাকি মারা গেছেন এ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। জোর দিয়েই তিনি বলছেন, দেশে বহিষ্কৃত সেনা কর্মকর্তা জিয়া এবং আকরামের কোনো অস্তিত্ব নেই। গতকাল র্যাবের সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছে, তাদের সন্দেহ জিয়া দেশের বাইরে রয়েছেন। একটি সূত্র এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ভয়ংকর এই জিয়া ইউরোপের একটি দেশের কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন এমন তথ্য তারা পেয়েছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুরষ্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বিষয়। এটা আমাদের কাজে কোনো প্রভাব ফেলবে না। মেজর জিয়া এবং মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই ভয়ংকর জঙ্গির অবস্থান নিশ্চিতের জন্য আমরা আগেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত ২০১৬ সালে জিয়াকে ধরতে পুলিশ সদর দফতর ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাকে ধরতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা অভিযান চালান গোয়েন্দারা। এর মধ্যে বাড্ডা, টঙ্গী ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে তিনটি বড় অভিযান পরিচালিত হয়। তবে প্রতিবারই জিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এ ছাড়া একবার চট্টগ্রামের দিকে তার অবস্থান শনাক্ত করেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। মাঝে কিছুদিন জিয়া সম্পর্কিত বিষয় চাপা পড়ে গেলেও গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভিজিৎ হত্যায় জড়িত জিয়া ও আকরাম হোসেনকে ধরতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করার পর নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গোয়েন্দারা বলছেন, আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়া প্রায় এক বছর আগে সংগঠনের দায়িত্বশীলদের কাছে নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এরপর থেকে তার কোনো তৎপরতা পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক গ্রেফতার হওয়া আনসার আল ইসলামের সদস্যদের কাছ থেকেও তার ব্যাপারে কোনো তথ্য মেলেনি। তবে গ্রেফতারকৃতরা দফায় দফায় বলেছেন, তারা সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘কাটআউট’ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। নতুন সদস্যরা কেবল তার ব্যাপারে শুনেই আসছেন। তাকে দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। তবে নজরদারি এড়াতে জিয়া কিংবা আকরামের মতো শীর্ষ নেতারা টেকনোলজি এড়িয়ে চলেন সব সময়। জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, মাঝে মনোযোগে কিছুটা ভাটা পড়ার সুযোগে আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামো কিছুটা শক্ত করেছে বলেই ধারণা তাদের। তথ্য আসছে, ধীর গতিতে হলেও সংগঠনটি নতুন সদস্য সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। চলমান রয়েছে দাওয়াতি কার্যক্রম। নতুন করে সংগঠনটির সামরিক শাখাও সংগঠিত করা হচ্ছে। সক্রিয় রয়েছে মুফতি বোর্ড, শূরা কমিটি, মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স শাখাও। সম্ভাব্য কাদের গ্রেফতার করলে জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব সে ব্যাপারে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে একাধিক সংস্থা। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে অনুমান করা যাচ্ছে, জিয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছেন। বাইরে অবস্থান করেই তার অতি ঘনিষ্ঠ বিশ্বস্ত সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তবে অবশ্যই তিনি নতুন নামে নতুন পাসপোর্ট নিয়েছেন। এমনও হতে পারে তিনি চেহারায় পরিবর্তন এনেছেন। নইলে তিনি এতদিনে ধরা পড়ে যেতেন। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে শনাক্ত করা ও আসামিদের গ্রেফতারে র্যাবই প্রথম কাজ করে। নারকীয় এই হত্যার বিচার নিশ্চিতে সরকার দৃঢ়ভাবে কাজ করেছে। মেজর জিয়াকে বিভিন্নভাবে খোঁজ করার জন্য র্যাব কাজ করেছে। সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। আনসার আল ইসলামের সঙ্গে মেজর জিয়ার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমেও তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র্যাব।
কমান্ডার মঈন আরও বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময় তথ্য ছিল মেজর জিয়া দেশে আছে, তখন আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করি। আমরা সন্দেহ করছি, সে এখন দেশের বাইরে রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারিও চলমান। এ বিষয়ে র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সে যদি দেশের বাইরে থাকে তাহলে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আর যদি দেশে আসে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে, তাকে গ্রেফতার করা হবে। গত মঙ্গলবার মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, দন্ডিত জিয়া ও আকরাম দেশে নেই। তারা অন্য দেশে গা ঢাকা দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাদের ধরে এনে রায় কার্যকর করা হবে। এ জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রসঙ্গত, মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ জঙ্গিদের হুমকির মুখেও ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে একুশের বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ সময় জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে অভিজিতের স্ত্রী বন্যাও মারাত্মক আহত হন। ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে উঠে আসে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নাম।