হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ আমার বন্ধু। অন্তরঙ্গ বন্ধু। ১৯৭২ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। সেখানে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। যুবরাজের মতো চেহারার দিলদরাজ টগবগে তরুণটি প্রথম পরিচয়েই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার ভাই।’ সেই থেকে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয় আমাদের। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল। শেষ জীবনে বিএনপিতে যেতে বাধ্য হলেও তার শরীর মনজুড়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শ। আওয়ামী লীগ করে মরার আকুতি ছিল তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে। কিন্তু তা আর হয়নি। অন্তহীন বেদনা-অভিমান কষ্ট নিয়েই চলে গেলেন আওরঙ্গ। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু সংবাদ বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে বসে যখন শুনলাম, আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমাদের আওরঙ্গ নেই। তার স্ত্রী-সন্তানের কথা মনে পড়ল। কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না। তার ছেলেটির বয়স তখন মাত্র ১২। হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ শুধু বন্ধুপ্রিয় ছিলেন না, তার মধ্যে অসাধারণ মানবিক গুণও ছিল। মানুষের দুঃসময়ে পাশে ছুটে যেতেন। কর্মীদের প্রতি কী যে দরদ ছিল যারা কাছে গেছেন তারাই জানেন। মাঠকর্মী অন্তঃপ্রাণ নেতা ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক। মেধা, মনন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও তার ছিল অবাধ বিচরণ। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আমরা ছাত্রলীগ করতাম। আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন শেখ জামাল, শেখ মারুফ, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী জহির, আবদুর রউফ, নশু ভাই (আমাদের সিনিয়র), ইমামুল কবির শান্ত (শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়)। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এখন জার্মানিতে আছেন লাভলুসহ অনেকেই। এম এস খান মঞ্জু, সাইফুর রহমান নান্টু, লুৎফর খান আজাদ, শামীম এস্কান্দার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিয়াজ রহিম। বন্ধুদের অনেকে এখন ভালো অবস্থানে আছেন আর অনেকে পরপারে চলে গেছেন। ১৯৭৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আওরঙ্গ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনে। আমি সমাজকল্যাণে। ১৯৭৫ সালে আমি চলে যাই রক্ষীবাহিনীতে। অন্যদিকে আওরঙ্গ দেশ-কাঁপানো ছাত্রনেতা হন। বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি। একটি কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৯৭৪ সালে শেখ কামাল দুস্কৃতকারীদের হামলার শিকার হন। পর দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩১২ নম্বর কেবিনে আমি কামাল ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম কামাল ভাই আওরঙ্গের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। শেখ কামাল আমাকে দেখে বললেন, কাছে আয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আওরঙ্গকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। রক্ষীবাহিনী ছেড়ে আমি মনোযোগ দেই ব্যবসা-বাণিজ্যে। আওরঙ্গ ব্যস্ত হন ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে। এ সময় দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নাম নেওয়া যেত না। বড় দুঃসময়। এ দুঃসময়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বেলে দেন আওরঙ্গ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপিয়ে তোলেন মিছিল-স্লোগানে। এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে। আওরঙ্গ হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের প্রতীক। তিনি হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের সাহস ও প্রেরণার উৎস। এ কারণে তৎকালীন সামরিক সরকার আওরঙ্গের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। কিন্তু কোনো কিছু তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সামরিক জান্তা আওরঙ্গের সহচর কাওসারকে গুলি করে হত্যা করে। গুম করে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ নেতা বাবুকে। মূলত গুমের রাজনীতির সূত্রপাত তখন থেকেই। একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। ১৯৮০ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার দীপ্ত শপথে দেশে ফিরে আসেন। আবারও গোপন অবস্থানে থেকে সক্রিয় করতে থাকেন ছাত্রলীগ-যুবলীগকে। একদিন শাহবাগে আÍগোপনে থাকা অবস্থায় তার ওপর আক্রমণ করে একটি সংস্থা। কোনো রকমে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তারপর আবার ভারতে পালিয়ে যান। এর পর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন রাজনীতির নতুন জীবন। কিন্তু মামলা থাকায় তাকে গোপন জীবন বেছে নিতে হয়। এ অবস্থায় আবদুর রাজ্জাকের ছেড়ে দেওয়া আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নেন। জয়ী হন বিপুল ভোটে। গোপনে সংসদে এসে শপথ নেন। আইনি লড়াইয়ের পর মুক্ত হয়ে যোগ দেন সংসদে। ’৯৬ সালেও তিনি বিজয়ী হন। আওরঙ্গের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। প্রিয় দল থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হলেও তিনি অন্য দলে যাননি। ২০০১ সালে দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। আওরঙ্গ ফুটবল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হন। স্রোতের বিপরীতে সেই যুদ্ধেও বীর মুক্তিযোদ্ধা আওরঙ্গের গলায় জয়ের বরমাল্য ওঠে। তবু দল তাকে ফিরিয়ে নেয়নি। তৃণমূল পর্যন্ত মানুষ তাকে ভালো বেসেছিল। কর্মীরা তাকে দাদা বলে হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছিল। সে কি আর হারতে পারে। তিনি আওয়ামী লীগে ফেরার চেষ্টাও করেন। কিন্তু চক্রান্তের কাছে জয়ী হতে পারেননি। সে কারণে ২০০৬ সালের আগে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপিতে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পর আওরঙ্গ দেশেই ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায়, অনিয়ম খুঁজে পায়নি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সময় প্রবাসে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানান এবং আবারও আওয়ামী লীগ করার আগ্রহ দেখান। শেখ হাসিনা তাকে তার বর্তমান অবস্থানে থাকার জন্য বলেন এবং টেলিফোন করার জন্য ধন্যবাদ জানান।
হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গকে নিয়ে অনেকে অনেক কিছু মনে করেন। অনেক কিছু ভাবেন। বাস্তবে আওরঙ্গ ছিলেন সাদামাটা, জনদরদি, কর্মীবান্ধব। তার প্রাণ ও আত্মা ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। লোভ-লালসা তাকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি। অর্থ ছিল না কিন্তু মনটা ছিল সমুদ্রসম। ব্যবসা-বাণিজ্য করে যা আয় করতেন তাই দান করে দিতেন। কর্মীরা তাকে দয়ার সাগর মনে করতেন। আওরঙ্গ মানুষকে ভালোবাসতেন, মানুষের ভালোবাসাও পেতেন। ছোট-বড় সবাইকে কাছে টানতে পারতেন। আমাদের সেই প্রিয় বন্ধু চলে গেলেন। বুকভরা কষ্ট, মনভরা অভিমান ছিল তার। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের জন্য তার অবদান ছিল। দক্ষ সংগঠক হিসেবে ছিল দলের জন্য অবদান। আওরঙ্গ কিছু দিন আগে বলেছিলেন, রাজনীতি তো আর হলো না, তাই স্ত্রী-সন্তানদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছি। কিন্তু রাজনীতি ও গণমুখী চরিত্রের আওরঙ্গ তার এলাকার মানুষের সঙ্গে ইফতার পার্টি করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বুকভরা কষ্ট, মনভরা অভিমান নিয়ে চলে গেলেন একদম বিনা নোটিসে। এ যাওয়া মানেই চলে যাওয়া নয়। তিনি বেঁচে থাকবেন কর্মী, মানুষ ও আমাদের মাঝে।
শিরোনাম
- যে কারণে গভীর পর্যবেক্ষণে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান, রয়টার্সের বিশ্লেষণ
- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ, তৈরি হচ্ছে মঞ্চ
- রাফাল যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলেছে ভারত, প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি
- সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা: শত শত মানুষকে সরিয়ে নিলো ভারত
- খায়রুজ্জামান লিটনের সাবেক এপিএস স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা টিটু আটক
- উত্তেজনা চরমে: পাকিস্তানের পক্ষে বার্তা দিলেন এরদোগান
- ‘সিনেমা’ থেকে ‘বাস্তব’ জগতে ফিরে আসুন, ভারতকে পাকিস্তানের আহ্বান
- ইংলিশ দলে ডাক পেলেন রিউ
- ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ‘আমাদের কোনও বিষয় নয়’ : যুক্তরাষ্ট্র
- এল-ক্লাসিকোর রেফারি চূড়ান্ত
- পাকিস্তান থেকে সরিয়ে যেখানে হবে পিএসএল
- সেলিনা হায়াৎ আইভী গ্রেফতার
- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা : নাহিদ
- পাকিস্তানি পাইলটকে আটকের দাবি ভারতের, প্রমাণ চাইল ইসলামাবাদ
- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের
- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাবিতে বিক্ষোভ
- প্রথম আমেরিকান পোপ রবার্ট প্রেভোস্ট
- বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি খাত হুমকিতে
- 'পাকিস্তান আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে সারা পৃথিবী জানবে'
- ভারতের সেনা-স্থাপনায় হামলা, অস্বীকার পাকিস্তানের
আমার বন্ধু আওরঙ্গ
খন্দকার কামরুল হক শামীম
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর

পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় সম্পূর্ণ ‘ব্ল্যাকআউট’ জম্মুতে পরপর বিস্ফোরণ, দাবি ভারতের
১৪ ঘণ্টা আগে | পূর্ব-পশ্চিম

পাকিস্তানের ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করার দাবি ভারতের
১৯ ঘণ্টা আগে | পূর্ব-পশ্চিম