চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আগের অভ্যুত্থানগুলোর থেকে বেশ কিছুটা ভিন্ন। অভ্যুত্থান ছাত্ররা শুরু করলেও এর যে শক্তি ও বেগ সেটা সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক জনমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। উনসত্তরেও ছাত্ররাই আরম্ভ করেছিল, অংশ নিয়েছিলেন কর্মজীবীরা ও মেহনতিরা; কিন্তু অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তখন এমন ব্যাপকতা ও এতটা স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। এত রক্তও ঝরেনি।
উনসত্তরের অভ্যুত্থান শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল; কিন্তু থামিয়ে দিয়েছে বুর্জোয়ারা; তাদেরকে সামাজিক বিপ্লবের আতঙ্কে পেয়েছিল। এবারের অভ্যুত্থানের জমিনটাও কিন্তু হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি; একদিকে ছিল মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কাজ; অন্যদিকে দুয়ের বিপরীতে বিগত সরকারের অভাবনীয় সন্ত্রাস। জমিন তৈরি হচ্ছিল দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, কিন্তু তাঁর শাসন ছিল পুরোদস্তুর পিতৃতান্ত্রিক এবং তিনি দমন-পীড়নের যে নজির রেখে গেলেন সে কাজ স্বাধীন বাংলাদেশের অন্য কোনো শাসক করতে পারেননি। ওই কাজ তিনি আরো করতেন, সশস্ত্র বাহিনী যদি অসম্মত না হতো।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পনেরো বছর নয়, দশ বছরের অধিক তাঁর পিতৃতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখতে পারেননি। জনতার অভ্যুত্থানে ভূপাতিত হয়েছেন। তিনিও চেয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করে, রক্তপাত ঘটিয়ে টিকে যেতে। সশস্ত্র বাহিনী সম্মত হয়নি বলেই তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। তবে তিনি পালাতে পারেননি; সদ্য-পতিত প্রধানমন্ত্রী যেমনটা পেরেছেন। শেষ মুহূর্তেও তাঁর ইচ্ছা ছিল সশস্ত্র বাহিনী আরো বেশি বল প্রয়োগ করুক। কিন্তু বাহিনীর প্রধানরা সম্মত হননি। যে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য তাঁরা প্রতিপালিত তাঁদের রক্তেই মাতৃভূমিকে সয়লাব করে দেবেন এমন কাজে সায় দেওয়াটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কারণ এবারকার অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দুটোই ছিল অনেক বিস্তৃত ও গভীর; আর বৈষম্যবিরোধিতার যে আওয়াজটা উঠেছিল সেটা ছিল প্রায় সর্বজনীন। শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য মানবে না বলে ফুঁসে উঠেছিল, কিন্তু তাদের অভিভাবকদেরও অধিকাংশের বুকের ভেতর ছিল ওই একই আওয়াজ; কারণ তাঁরাও নানাভাবে এবং বহু রকমের বৈষম্যের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। সমাবেশে ও মিছিলে যাঁরা এসেছেন তাঁরা বৈষম্য কী জিনিস সেটা মর্মে মর্মে জানেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ‘সুদৃশ্য’ অট্টালিকাটি যে দাঁড়িয়ে আছে তার গোড়ায় রয়েছে বৈষম্য। যাঁদের শ্রমে এর নির্মাণ তাঁরা এই অট্টালিকার আরামদায়ক অভ্যন্তরে ঠাঁই পান না, তাঁরা থাকেন নির্মাণের ফলে তৈরি খানাখন্দে। অসন্তুষ্ট ও অশ্রুসিক্ত বঞ্চিতদের কাঁধের ওপর ভর করেই গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা টিকে আছে, নিচের মানুষ নড়েচড়ে উঠলেই সর্বনাশের শঙ্কা। নিচের মানুষদের তাই দাবিয়ে রাখা হয়, ভয় দেখানো হয় যত প্রকারে পারা যায়।
রাষ্ট্র তারুণ্যকে ভয় করে, সমাজও যে তারুণ্যকে পছন্দ করে তা নয়। তারুণ্যকে দমিত করার সব ব্যবস্থা রাষ্ট্র তার নিজের অভ্যাসবশতই করে থাকে, সমাজও তাতে যোগ দেয়। একটা ব্যাপার ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু মোটেই ছোট নয়; সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন না দেওয়া। সেখানে দুঃসহ একাধিপত্য চলে সরকারি দলের ছাত্রদের। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষাটা তরুণরা পেতে পারে শিক্ষায়তনিক ছাত্রসংসদ থেকেই। ছাত্রসংসদ আগে ছিল; এমনকি সামরিক শাসনের সময়েও ছাত্রসংসদকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯১তে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকাররা যখন ক্ষমতায় আসা-যাওয়া শুরু করল ঠিক তখন থেকেই ছাত্রসংসদ লুপ্ত হয়ে গেল, চলল সরকারদলীয় ছাত্র নামধারীদের স্বৈরাচার। এই যে ‘অগ্রগতি’ এর তাৎপর্যটা কী? তাৎপর্য হলো এটাই যে এরই মধ্যে রাষ্ট্র আরো বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে, যাত্রা করেছে ফ্যাসিবাদের অভিমুখে, যার আপাত-চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল পতনপূর্বে বিগত সরকারপ্রধানের জমিদারতন্ত্রে। তরুণরা গুণ্ডা-বদমাশ হোক, মাদকের পাল্লায় পড়ুক, তারুণ্য গোল্লায় যাক, কিশোর গ্যাং গঠিত হোক- কোনো কিছুতেই আপত্তি তো নেই-ই, বরং সাগ্রহ অনুমতি আছে; কারণ তরুণ যত তার তারুণ্য খোয়াবে শাসকদের গদি ততই পোক্ত হবে। সোজা হিসাব!
বৈষম্যবিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতিপুরাতন রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না, হবেও না যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে এবং বাড়ছেও। উনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর মওলানা ভাসানী তাঁর সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।’ বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙিক্ত। ওই উনসত্তরেই ভাসানীপন্থী তরুণ আসাদ যখন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তখন তাঁর সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহীদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার মানুষ। সে ধারাও বৈষম্যবিরোধিতারই, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে।
ওই ধারা জয়যুক্ত হয়নি। এবারও হয়নি। যে জন্য বারবার আমাদের আন্দোলনে যেতে হচ্ছে, ঘটাতে হচ্ছে নতুনতর অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান জনগণই ঘটান, কিন্তু ক্ষমতায় রয়ে যান বুর্জোয়ারাই। নতুন পোশাকে, নতুন নামে, নতুন ভাষায় তাঁরাই আসেন, বারবার ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে। পরের শাসক আগের শাসকের তুলনায় অধিকতর নির্মম হন। বুর্জোয়া শাসনের পতন কোনোকালেই ঘটবে না যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদায় নেয়। আমাদের দেশে রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা মাত্র দুটি। একটি বুর্জোয়াদের, অপরটি জনগণের। বুর্জোয়া ধারাটিই প্রধান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অতিশয় ভদ্র উদারনৈতিকরা যেমন ভয়াবহ রকমের রক্ষণশীলরাও তেমনি এই ধারারই অন্তর্গত। বাইরে যা হোন না কেন, অন্তরে এঁরা সবাই ব্যক্তিমালিকানায় ও ব্যক্তিগত মুনাফায় বিশ্বাসী এবং পুঁজিবাদের সমর্থক। এই ধারার বিপরীতে এবং সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষে রয়েছে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক ধারাটি। সেটি সমাজতান্ত্রিক। ওই ধারার লক্ষ্য সম্পত্তিতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা।
আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীদের প্রধান দুর্বলতা ঐক্যের অভাব। পুঁজিবাদীদের জন্য কিন্তু সেই সমস্যাটা নেই; তাদের মধ্যে ঝগড়া আছে অবশ্যই, খুনাখুনিও ঘটে, বিষয় সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে পরিবারের মধ্যে যেমনটা ঘটে থাকে; কিন্তু আদর্শগত লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ, আর সে লক্ষ্যটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সচল রাখা। এ ক্ষেত্রে তারা একাট্টা; এবং তাদের সবার সুনির্দিষ্টি শত্রু হলো সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীরা চান সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক সম্পর্কগুলোকে মানবিক করতে ও টিকিয়ে রাখতে। অর্থাৎ মানুষের মনুষ্যত্বকে বজায় রাখতে এবং বিকশিত করতে। বুর্জোয়াদের সাধনা শোষণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার। দ্বন্দ্বের ওই নাটকটা চলছে, অভ্যুত্থানও ঘটছে, কিন্তু বৈষম্য ঘুচছে না, ক্ষমতা রয়ে যাচ্ছে নিপীড়ক বুর্জোয়াদের হাতেই। হাতবদল ও হাতসাফাই-ই ঘটছে শুধু, খেলার তাসের মতো। এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনেই বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দানবে পরিণত করতে চায়। নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পায়, কারণ বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ে, তারা বিক্ষোভ করে, বিদ্রোহে অংশ নেয়, এবং সম্ভাবনা দেখা দেয় পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামটা জোরদার হওয়ার।
আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীরা সব গণ-অভ্যুত্থানেই থেকেছেন, অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজও করেছেন; কিন্তু তাঁরা নেতৃত্ব দিতে পারেন না, বিভক্তি ও বিভ্রান্তির কারণে। আর এই সুযোগটি নিয়ে থাকে বুর্জোয়ারা। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ