বঙ্গোপসাগরে ফের ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। মাছধরার ট্রলার ডাকাতিতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে জলদস্যুরা। ডাকাতি করার সময় নিজেদের ট্রলারের পরিবর্তে পরিচিত ট্রলার কিংবা ফিশিংবোট ব্যবহার করছে। অপহরণ করে দাবী করছে মুক্তিপণ। এতে করে নতুন আতঙ্ক ভর করেছে জেলেদের মধ্যে।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোসত্মাক আহমদ জানান, সাগরে প্রতিনিয়তই ডাকাতি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত দশটি ফিশিংবোট ডাকাতির শিকার হয়েছে। জলদস্যুদের হাতে অন্তত ৫০ মাঝিমাল্লা গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে। কোস্টগার্ডের দুর্বলতার সুযোগেই এসব ঘটনা ঘটছে।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়ায় বিভিন্ন এলাকার ডাকাতরা জড়ো হয়েছে। সেখানে শক্ত ঘাঁটি বেঁধেছে তারা। তবে ইলিশ ধরার মৌসুমকে টার্গেট করে তারা জড়ো হচ্ছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে তারা কয়েকটি বোটে ডাকাতিও চালিয়েছে। এ কারণে জেলে ও বোট মালিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জেলেরা জানায়, সোনাদিয়ার দুর্ধর্ষ জলদস্যু জাম্বু বাহিনী, সরওয়ার বতইল্যা বাহিনী ও জলদস্যু সম্রাট নাগু মেম্বারের ছেলে নকিব বাহিনী এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাদের নেতৃত্বে বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, হাটখালী, চকরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার দস্যুরা সোনাদিয়া চ্যানেলে জড়ো হয়েছে।
এ বাহিনীতে রয়েছে সোনাদিয়া এলাকার শাব্বির ডাকাত, আব্দুল মোনাফ, মোবারক, আনজু, জাহাঙ্গীর, বক্কর, সাদ্দাম, আবুল কালাম, আব্দুল বারি, শফি ডাকাতসহ অন্তত অর্ধশত জলদস্যু। তারাই পুরো সাগর নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিনিয়তই চালাচ্ছে দস্যুতা ও লুটপাট।
সোনাদিয়ায় জড়ো হওয়া ডাকাতরা ইতোমধ্যে ফিশিংবোটে হানা দিতে শুরু করেছে। সমপ্রতি ৩টি বোটে ডাকাতি চালিয়ে মাছসহ সর্বস্ব লুট করেছে। জলদস্যুদের গুলিতে গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক মাঝিমাল্লা আহত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বোট মালিক জানান, সোনাদিয়ায় জড়ো হওয়া ডাকাতরা মুঠোফোনে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিচ্ছে। টাকা না দিলে তার বোট লুট করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০ অক্টোবর মঙ্গলবার সকালে বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া চ্যানেল থেকে অস্ত্রের মুখে 'এফবি ভাই ভাই' নামে একটি ফিশিংবোটসহ মাঝিকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে জলদস্যুরা। অপহৃত মাঝির নাম শাকের উল্লাহ। তিনি শহরের কুতুবদিয়াপাড়ার এলাকার আব্দুল নবীর ছেলে। এ সময় ডাকাতের কবল থেকে অন্য একটি বোটে করে ১৭ মাঝি-মাল্লা ফিরে এসেছে।
অপহরণের শিকার ফিশিংবোটের মালিক ফজল করিম কোম্পানি জানান, ১৮ মাঝিমাল্লা নিয়ে ট্রলার গত ১৮ অক্টোবর সাগরে মাছ ধরতে যায়। তাদের সঙ্গে ১৫ দিনের খাবার ও রসদপত্র ছিল। সাগরে নামার দুই দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবলে পড়ে বোটটি। বোট মালিক ফজল করিম কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
তিনি বলেন, ‘ডাকাতদল ১৭ মাঝিমাল্লাকে অন্য একটি বোটে তুলে দিয়ে মাঝিকে নিয়ে যায়। সাগরে মাছ ধরার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হয় তিন দিন আগে। এরপর ফিশিংবোটগুলো সাগরে নামা শুর’ করেছে মাত্র। এ সময়েই জলদস্যুদের উপদ্র’প মত্স্যজীবীদের পরিবারে উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।
২১ অক্টোবর বুধবার ভোরে শওকতুল ইসলামের 'এফভি নাসের' নামের একটি ফিশিংবোট এই দস্যুতার শিকার হয়। কক্সবাজার শহরের কলাতলি পয়েন্ট থেকে অন্তত ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে এ ঘটনা ঘটে। জলদস্যুদের ছোঁড়া গুলিতে দুই মাঝিমাল্লা গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১৮ জন আহত হয়েছে। এ সময় অন্তত এক লাখ টাকার মাছসহ ট্রলারের বিভিন্ন সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে গেছে জলদস্যুরা।
এ ঘটনায় আহত অন্যান্য জেলেরা হলো আব্দুর রশিদ, সাদ্দাম হোসেন, আব্দুল্লাহ, ইলিয়াছ, জাহেদ, শওকত, শুক্কুর, নাসির, কামাল, মু. আলম, ছিদ্দিক, শাব্বির আহমদ, পাটোয়ারী। এদের মধ্যে কেউ গুর’তর আহত হয়নি। তাদেরকে স্থানীয়ভাবে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে।
আহত অবস্থায় ফিরে আসা জেলে আব্দুর রশিদ জানায়, ২০/৩০ জনের একদল সশস্ত্র জলদস্যু গত দুই দিন আগে চালকসহ অপহৃত 'ভাই ভাই ফিশিংবোট' নিয়ে এসে তাদের উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ ও ব্যাপক মারধর করে। পরে লক্ষাধিক টাকার মাছসহ বোটের বিভিন্ন সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে যায়।
বোট মালিকরা জানান, প্রজনন মৌসুমের পর প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। কিন্তু তারা এখন কূলে ফিরতে ভয় পাচ্ছে। সোনাদিয়ায় জড়ো হওয়া ডাকাতরা প্রস্তুত থাকায় যে কোনো মুহূর্তে ডাকাতির ঘটনা ঘটতে পারে। জলদস্যুদের দ্রুত গ্রেফতার না করলে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, ইলিশ প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া শুরু করেছে। মৌসুমের শুরুতেই অপহরণের খবরে জেলেদের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক ভর করছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার কোস্টগার্ড স্টেশনের পিটি অফিসার নান্নু মিয়া বলেন, ‘সাগরে দস্যুতা আতঙ্ক ও উদ্বেগের। দস্যুতা বন্ধে যৌথ অভিযান জরুরি। এ জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি দরকার। যৌথ অভিযান পরিচালনা করা গেলে জলদস্যুতা বন্ধ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে অবগত হয়েছে। সাগরে দস্যুতা বন্ধে করণীয় ঠিক করতে যৌথসভা ডাকা হয়েছে।'
বিডি-প্রতিদিন/২১ অক্টোবর ২০১৫/শরীফ